যে সমাজের লেখক বুদ্ধিজীবীরা সাম্প্রদায়িক হয় সেদেশের সাধারণ মানুষ ধর্মান্ধ হবে এটাই স্বাভাবিক।

কোলকাতার বিখ্যাত ‘সেন ব্রাদার্স’ বইয়ের দোকান। দোকানের মালিক ও প্রকাশক ভোলানাথ সেন তার দুজন কর্মচারী নিয়ে দোকানে বসে আছেন। দুজন ক্রেতা তখন দোকানে আসে বই কেনার জন্য। বই কেনার উছিলায় হঠাৎই ক্রেতা দুইজন চাপাতী হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভোলানাথ সেনের উপর! রক্তে ভেসে যায় সেন ব্রাদার্সের শো-রুম। ১৯৩০ সালের এই খুনটি ছিলো আলোচিত। একজন প্রকাশক খুন হলেন নিজ কার্যালয়ে। মানুষ জেনে বিস্মিত হলো বই প্রকাশের জন্য কেউ খুন হতে পারে শিল্প সাহিত্যের শহর কোলকাতাতে! সেকালের বুদ্ধিজীবীদের এই ঘটনা বেশ নাড়া দিয়েছিলো। কি ঘটেঠিলো আসলে সেন ব্রাদার্সের বইতে?

সেন ব্রাদার্স থেকে ‘প্রাচীন কাহিনী’ নামে তৃতীয় ও চর্তুথ শ্রেণীর পাঠ্য হিসেবে একটি বই ভোলানাথ সেন প্রকাশ করেছিলেন। বইটির লেখক স্বয়ং ভোলানাথ সেন। এটি সরকার পাঠ্য পুস্তক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। সেই বইতে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদের নামে যে চ্যাপ্টার ছিল সেখানে ভাল ভাল কথা বলে তাকে সম্মান করা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে একটা ছবি ছাপা হয়েছিল যেখানে মসজিদে মুহাম্মদ দাঁড়িয়ে আছেন আর তার সামনে জিব্রাইল উপস্থিত। এই ছবিটি বৃটিশ মিউজিয়াম থেকে অনুমতি নিয়ে বইতে প্রকাশ করা হয়েছিল। অর্থ্যাৎ, এই ছবিটি বৃটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে। কিন্তু ঢাকার একজন মুসলমান জমিদারের ধর্মানুভূতিতে প্রচন্ড আঘাত লাগে এই ছবি দেখে। সে কোলকাতায় এসে দুজন পাঞ্জাবী মুসলমান যু্বককে উদ্বুদ্ধ করে এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। জমিদারের কথামত দুই যুবক ভোলানাথকে খুন করে যায় ক্রেতা সেজে। বিপ্লবী নগেন্দ্রনাথ দত্ত এই সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেছিলেন, ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে আমরা যখন স্বদেশী করে আলীপুরে প্রেসিডেন্সী জেলে ছিলাম তখন ঐ যুবক দুটিও এই জেলে ছিল। দেখতাম তাদের দেখতে মুসলমান নারী-পুরুষ এসে ভীড় করত। তারা তাদের ভক্তিশ্রদ্ধা জানিযে যেতো। পরে মুসলিম সমাজের কাছে তারা শহীদের মর্যাদা পেযেছিল।
সমসামিক সময়ে রবীন্দ্রনাথের নতুন কবিতা বের হয়। ‘কথা ও কাহিনী’ কাব্যগ্রন্থের মানি কবিতায় ‘আরঙজেব ভারত যবে/ করিতেছিল খান খান’ লাইনটি মুসলিমরা তাদের “পূর্বপুরুষদের” অপমানিত করা হয়েছে বলে দাবী করে রবীন্দ্রনাথকে ক্ষমা চাইতে বলেছিল। বলেছিল, ঐ লাইন তুলে নিতে হবে…। রবীন্দ্রনাথ নতি স্বীকার করেননি। কিন্তু ক্রমশ হিন্দু মুসলমান নিয়ে বাংলার ভবিষ্যত নিয়ে সকলেই চিন্তিত হচ্ছিল। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সঙ্গে শরতচন্দ্রের আলাপ থেকে বেরিয়ে আসে সেই শংকার কথা। শরতচন্দ্রকে মুসলিম সমাজ থেকে বারবার অনুরোধ করতে থাকে তাদের সমাজ নিয়ে লিখতে। কিন্তু শরত শংকিত ছিলো এইসব ঘটনাগুলির কারণে। জাহানারা চৌধুরী সম্পাদিত ‘বর্ষবাণী’ (১৩৪২ বঙ্গাব্দ) সংখ্যায় মুসলমান সমাজের ক্রমাগত অনুরোধ প্রসঙ্গে শরতচন্দ্র তখন লিখেন, ‘…প্রশংসার সঙ্গে তিরস্কার, ভাল কথার সঙ্গে মন্দ কথাও গল্প উপন্যাসের অপরিহার্য অঙ্গ। কিন্তু এ তো তোমরা না করবে বিচার, না করবে ক্ষমা। হয়ত এমন দন্ডের ব্যবস্থা করবে যা ভাবলেই গা শিউরে উঠে! …

ভাবা যায় ১৯৩০ সালে ভাগলপুরে বসে শরতচন্দ্র নিজের কল্লা যাবার ভয়ে মুসলিম সমাজ নিয়ে উপন্যাস লিখতে চাচ্ছেন না! আর আমাদের ভামরা এসে ইতিহাস শোনায় বিজেপি আরএসএস এসে নাকি দুই ভাইয়ের মধ্যে বিরোধ বাঁধিয়ে দিয়েছে! অবিভক্ত বাংলায় ক্রমশ এমন সব ঘটনা ঘটছিলো তা যেন চিরকালীন বিভেদ ভাগ বাটোয়ারার দিকেই সব কিছুকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। ‘সাহিত্য সম্রাট’ বঙ্কিমকে নিয়ে ‘বঙ্কিম দুহিতা’ নামের একটি বই তখন বের হয় যার লেখক একজন মুসলিম যেখানে চটি ভাষায় বঙ্কিমকে আক্রমন করা হয়।...

মীর মোশাররক হোসেন ছিলেন বলা চলে সেকালের প্রগতিশীল একজন লেখক। তিনি যে ভাষায় বিষাদ সিন্ধু লিখেছিলেন তাতে তার ধর্মনিরপেক্ষ ভাষা নীতি পরিস্কার হয়ে উঠে। তার গো-সংবাদ বইটিতে ছিলো মুসলমানদের প্রতি গরুর মাংস না খাওয়ার অনুরোধ যুক্তিসহকারে। কিন্তু তার আত্মজীবনীতে আত্মঘাতী মুসলিম জাতীয়তাবাদের উপস্থিতি দেখে আশা ভরসা সব বিলিন হয়ে যায়।

তার আত্মজীবনী ‘আমার জীবন’ এ “বঙ্গে মুসলমান কী রুপ শোচনীয় দশা ছিল তা ভাবিলে অঙ্গ শিহরিয়া ওঠে। আমি সেই দুর্ঘটনা যাহা স্বচক্ষে দেখিয়াছি তাহাই জীবনীতে সন্নিবেশিত করিব। জাতীয় বিদ্যা শিক্ষায় শৈথিল্য, জাতীয় ভাব রক্ষায় শৈথিল্য, শাসন, বিচার, রাজ্য বিভাগ, সমগ্র বিভাগেই মোসলমান শূন্য। বিজাতীয় ভাষার কল্যাণে রাজপুরুষদিগের সহিত মাখামাখি ভাব। কাজেই নির্জীব নিরক্ষর বঙ্গীয় মুসলমান কার্যে তাহাদেরই আদর্শ গ্রহণ করিয়াছিলেন। অনেক বড় বড় জমিদার ধনী মুসলমান জোড়া জোড়া প্রতিমা তুলিয়া আশ্বিন মাসে প্রতিমা কল্যাণে হাজার হাজার বাহবা গ্রহণ করিয়াছিলেন।’… আরেক জায়গা মোশাররফ লিখেন, “আমি সেই সময়ের কথা বলিতেছি। পঠন পরিচ্ছেদ হিন্দুয়ানী, চালচলন হিন্দুয়ানী, রাগ ক্রোধ হিন্দুয়ানী, কান্নাকাটি হিন্দুয়ানী, মুসলমানদের নামও হিন্দুয়ানী। যথা- সামসুদ্দিন – সতীশ, নাজমুল হক-নাজু, বোরহান-বীরু, লতিফ-লতু, মশাররফ-মশা, দায়েম-ডাশ, মেহেদি-মাছি, ফজলুল করিম-ফড়িং এই প্রকার নামে ডাকা হয়’।

মুসলিম সমাজে যে ধর্মের আড় ভাঙ্গেনি কারণ এই সমাজের লেখকরা নিজেদের গোঁড়ামীর পক্ষালম্বণ করেছিলেন। ১৯৩০ সালের বঙ্গের মুসলিম সমাজ একজন খুনিকে যেভাবে হিরো করে নিয়েছে আজো তাই রয়ে গেছে। কারণ এই সমাজের লেখক বুদ্ধিজীবীরা ‘বাঙালী মুসলমান লেখক’ হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেন। ‘প্রাচীন কাহিনী’ বইতে ভোলানাথ সেন পয়গম্ব মুহাম্মদকে মনিষী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে নিজের বইতে স্থান দিয়েছিলেন যা হিন্দু বাচ্চারাও পড়ত। অথচ সেই ভোলানাথ সেন খুন হলেন মুহাম্মদের চ্যাপ্টার রাখার কারণেই! একটা হিংস্র সাম্প্রদায়িক সাম্রাজ্যবাদ ও মাফিয়া জাতীয়তাবাদকে মহান আদর্শ দেখিয়ে অমুসলিম সমাজ কোনদিন ভালো কিছু আদায় করতে পারেনি। কোলকাতায় এখন যে দাদা দিদিরা একই কাজ করছে জনসভায় নারায়ে তাকবির দিয়ে তারা আসলে ফের ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে-কে ডেকে আনছেন। আমি মুসলিম কমিউনিটির বিরুদ্ধে আপনাদের অবস্থান নিতে বলছি না। আমি শুধু অনুরোধ করব, হে পশ্চিমবঙ্গের দাদা দিদি, বাংলাদেশের তখাকথিত প্রগতিশীল মুসলমানবৃন্দ্র, ইসলামের বিরুদ্ধে যে কোন বিরূপ প্রক্রিয়াকে আস্তে আস্তে মুসলমানদের অভ্যস্থ হতে সহায়তা করুন। মুসলমান সম্প্রদায়ের এখনো ধর্মঘুম ভাঙ্গেনি। সেই ঘুম ভাঙ্গাতে হবে। এইদেশে লালন জন্মেছিলেন। মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি...। এই রকম দর্শন থাকতে কি করে এখানে মুসলিম জাতীয়তাবাদ, দিতে পারে? কিন্তু পেরেছে। কারণ যে সমাজের লেখক বুদ্ধিজীবীরা সাম্প্রদায়িক হয় সেদেশের সাধারণ মানুষ ধর্মান্ধ হবে এটাই স্বাভাবিক।

-সুষুপ্ত পাঠক

#সুষুপ্তপাঠক
01 July 2022

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted