শোনেন ভাই, আল্লাহ যদি বলে কাফের ধরে ধরে মারতে হবে সেটাই মুমিন হিসেবে আমাদের কর্তব্য! প্রয়োজনে তাই করব…। তাতো ঠিকই, ধর্ম পালন বলে কথা।

বুয়েটে পড়া এলাকার ছোট ভাইকে দেখি রাস্তার অপর পাশের ফুটপাথে হাত উঁচিয়ে আছে। টাকনুর উপর জিন্স গোটানো। মুখে দাড়ি। কেমন আছো জিজ্ঞেস করলে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ ছাড়া আর কিছু বলে না। সে হাত উচিয়ে আমাকে ডেকেই রাস্তা পার হয়ে আমরা দিকেই আসছে। কাছে আসতেই জিজ্ঞেস করলাম, কি খবর কেমন আছো?
ছোকরা উত্তর দিলো, আলহামদুলিল্লাহ…। তা আপনি কেমন আছেন?

বললাম, হিজিবিজি হিজিবিজি…

ছোকরা চোখ কুচকে বলল, জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছেন আর আপনি বললেন হিজিবিজি হিজিবিজি?

-তুমিও তো একই কাজ করলে, আমি জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছো, তুমি জবাব দিলে সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর!
ছোকরা থতমত খেয়ে বলল, আমরা মুসলমানরা সকল অবস্থায় আল্লার প্রশংসা করি।

-সেটা করো কে মানা করেছে? কিন্তু এটা তো কুশলের উত্তর হলো না। যেমন আমার হিজিবিজি বলার মত…

-ভাই, আপনাদের মানে নাস্তিকদের কি সমস্যা জানেন?

-কি সমস্যা?

-সহজ জিনিসরে খালি প্যাচান!

-ও আচ্ছা। ঠিক আছে বাদ দাও। বলো তাহলে কেমন আছো?

-ভাল আর থাকতে দিলেন কই আপনারা?

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, কেন আবার কি হলো?

-কাল রাতে ফেইসবুকে এক নাস্তিকের সঙ্গে তর্ক। সে সুরা তওবার ৫ নম্বর আয়াত দেখিয়ে বলে সেখানে নাকি অমুসলিমদের ধরে ধরে খুন করার কথা বলা হয়েছে…। এই হিন্দুগুলি কুরআন না বুঝে মাঝখান থেকে আয়াত কাটছাট করে অর্থ বিকৃত করে নিয়ে আসে…।

-তা লোকটা যে হিন্দুই ছিলো নিশ্চিত হলে কিভাবে?

-দেখেন ভাই কোন প্রকৃত নাস্তিক খালি ইসলাম ধর্ম নিয়ে পড়ে থাকে না। আমার ফ্রেন্ড লিস্টে অনেক কমিউনিস্ট নাস্তিক বড় ভাই আছে, তারা বলেছে, প্রকৃত নাস্তিক কখনই ইসলাম ধর্মের সমালোচনা করে না। তারা সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ইজরাইলের দখলদারীর সমালোচনা করে। দেশে কত সমস্যা, ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমানদের গরুর মাংস খেতে দিচ্ছে না, নামাজ পড়তে দিচ্ছেন- এসব নিয়ে না লিখে যারা কেবল ইসলাম ধর্ম নিয়ে লেখে তারা প্রকৃত নাস্তিক না। এরা আসলে হিন্দু। এদের মনে খালি ইসলাম বিদ্বেষ…।

-তা তোমাদের এই বামাতী ভাইয়ারা সুরা তওবা নিয়ে কিছু বলে না?

-কথা যখন তুললেন আসনে ঐখানে গিয়ে একটু নিরিবিলি বসি।

কমলাপুর স্টেশনে তখন একটা ট্রেন চলে গেছে। প্লাটফর্ম একদম ফাঁকা। আমরা স্টেশনে ঢুকে একটা সিমেন্টের বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম।

-আচ্ছা ভাই, আপনারা যে সুরা তওবার যে আয়াতটা দেখান যেখানে বলা আছে ‘মুশরিকদের যেখানে পাবে হত্যা করবে’ এটা কি আসলেই অমুসলিমদের হত্যার কথা বলেছে? এই সুরার প্রেক্ষাপট না জেনে, আগে পরে কি বলা আছে তা না জেনে মাঝখান থেকে অর্থ করলে কি হবে? আচ্ছা বলেন তো, যুদ্ধ ক্ষেত্রে কি মুসলমানরা তাদের প্রতিপক্ষকে ধরে ধরে চুমা খাবে? একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা কি পাকিস্তানীদের ছেড়ে দিয়েছে?

-তুমি বলতে চাইছ এই আয়াত ঐ সময় কাফেরদের সাথে যে যুদ্ধ হয়েছিলো তার পেক্ষাপটে নাযিল যেহেতু হয়েছে কাজেই এই আয়াত কেবল মাত্র ঐ সময়ের জন্যই প্রজয্য?

ছোকরা খুব চতুর। আমার ফাঁদে পা দিলো না। সে হ্যাঁ বললে তাকে মেনে নিতে হবে কুরআন হচ্ছে নির্দিষ্ট ঘটনাবলীর উপর তখনকার কথাবার্তা মাত্র। তাহলে আর সে বলতে পারবে না কুরআন হচ্ছে মুসলমানদের জীবনবিধান। তাই কথা ঘুরিয়ে সে বলল, শোনন ভাই, মুসলমানদের বিরুদ্ধে যারা শত্রুতা করবে কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানরা কি তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে না? তারা কি ফুলের মালা নিয়ে বসে থাকবে নাকি? এটা তো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার যে একজন সেনা প্রধান তার সৈন্যদের উদ্দীপিত করার জন্য বলবে যেখানে শত্রু পাবে হত্যা করবে, সে কি বলবে তাদের যেখানে পাবে ফুলের মালা গলায় দিবে?

আমি মুচকি হেসে সিগারেট ধরালাম। বললাম, তুমি আসলে কি বলতে চাও? কুরআনে অমুসলিমদের সম্পর্কে এরকম কিছু করার কথা লিখেনি? যদি তুমি এটা বলো আমার কিছু বলার থাকবে না কারণ এটা তো খুবই খুশির খবর কারণ এর মাধ্যমে মুসলমানরা জানতে পারবে এইসব আয়াত কেবল মাত্র ১৪০০ বছর আগের কুরাইশদের সঙ্গে মুসলমানদের যে বিবাদ ঘটেছিলো তার প্রেক্ষিতে রচিত হয়েছিলো। বর্তমানে এই আয়াতের কোন কার্যকারীতা নেই- তাই তো?

-ছোকরা পাছা মুচরালো। মানে আমি বুঝি নাই। আমি মনে মনে হাসছি। অমুসলিমদের হত্যার কথা কুরআন আদেশ দিয়েছে এটা সরাসরি মানতে তার আপত্তি আছে। তার কথা কুরআন ইসলামের শত্রুদের, মুসলমানদের শত্রুদের কিভাবে মোকাবেলা করবে তার কথা বলা আছে। সে সুরা তওবাকে সন্ত্রাসবাদী সুরা বলতে নারাজ কিন্তু কথিত ইসলামের শত্রুদের কিভাবে ‘মোকাবেলা’ করতে হবে তার পক্ষে সাফাই গাইছে। এরা বেকায়দা পড়লে সুরার প্রেক্ষাপট দেখতে বলে, কিন্তু কুরআনে নারীর প্রতি কঠর পর্দা বিষয়ে কখনই প্রেক্ষাপটের কথা তুলে না। ঘড়ির দিকে তাকালাম। একটা কাজে যাবার কথা, আধ ঘন্টার মত সময় আছে, কথা আর না বাড়িয়ে তাই মূল বিষয় নিয়ে আলাপ করতে হবে। ছোকরা মুখে তর্ক জয়ের তেলতেলে একটা ভাব। বললাম, শোনো, তুমি আমি ইসলাম বেশি জানি এরকম গর্ব না করে আসো ইসলামী পন্ডিতরা কি বলেছে দেখি। তুমি সুরা তওবার প্রেক্ষাপটের কথা বললে, প্রেক্ষাপট ধরে সুরার অর্থ করলে কিন্তু কুরআনের অর্থ আরো হিংস্র হয়ে উঠবে। যাই হোক, আসো সুরা তওবার সর্বমান্য তাফসিরে ইবনে কাসির থেকে দেখি সত্যিই এই সুরাতে কি বলা আছে।

পকেট থেকে মোবাইল বের করে নেট চালু করে গুগল করে ইবনে কাথিরের তাফসির বের করলাম। সুরা তওবার তাফসির। তাকে দেখিয়ে পড়তে লাগলাম:

মুশরিকদের মধ্যে যাদের সঙ্গে তোমরা সন্ধিচুক্তি করেছিলে, তাদের সাথে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ হতে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেওয়া হল। ২. অতঃপর (হে কাফিরগণ!) চার মাস তোমরা জমিনে (ইচ্ছেমত) চলাফেরা করে নাও; আর জেনে রেখ যে, তোমরা আল্লাহকে অপারগ করতে পারবে না। আর নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদের লাঞ্ছিতকারী।” [সূরা আত-তাওবাহ: ১-২] চলো দেখি এর তাফসিরে ইবনে কাথির কি বলেছেন, আমি পড়তে লাগলাম, ‘রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবম হিজরি সনে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে হজের আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য প্রেরণ করেন। আর সূরা ‌আল-বারা’আতের (সুরা তওবা) ত্রিশটি অথবা চল্লিশটি আয়াত সহকারে আলী ইবনু আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে প্রেরণ করেন। তিনি এগুলো লোকদের সম্মুখে পাঠ করে শোনান। আর তিনি মুশরিকদেরকে চার মাস সময় দেন, যে সময় তারা স্বাধীনভাবে জমিনে বিচরণ করতে পারবে। তিনি তাদের সম্মুখে আরাফার দিন এ আয়াতগুলো পাঠ করেন। যিলহজ মাসের বিশ দিন, মুহাররাম, সফর, রবিউল আউওয়াল এবং রবিউল আখিরের দশ দিন অবকাশ দান করেন। তিনি তাদের আবাসস্থলগুলো গিয়ে ঘোষণা দেন যে, এই বৎসরের পরে কোনো মুশরিক হজ করবে না আর উলঙ্গ হয়ে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে না’।

আমি ছোকরা চোখের দিকে চেয়ে বললাম, এখানে কোথায় যুদ্ধ বিগ্রহ দেখাও তো? আবু বকর আর আলী মক্বাতে গিয়ে এই আয়াতগুলো হাজীদের তাবুতে গিয়ে পড়ে শুনিয়েছে যেখানে বলা হয়েছে সামনের বছর আর আবু জাহেলরা হজ করতে পারবে না, চার মাস পর তাদের যেখানে পাওয়া যাবে তাদের হত্যা করা হবে- এসব বলে তারা সহিসালামতে মদিনাতে চলেও গিয়েছিলো। আর তুমি বলছ যুদ্ধ ক্ষেত্রে একজন সেনা প্রধান কি শত্রুদের ফুলের মালা দিবে? যুদ্ধই যদি হবে তাহলে আবু বকর আর আলী কিভাবে বুক ফুলিয়ে মক্কাতে গিয়ে হজে অংশগ্রহণ করল? চিন্তা কর তো, শত্রুদের আস্তানাতে গিয়ে হুমকি দিচ্ছে সামনের বছর তারা কেউ হজ করতে পারবে না, হজ করবে কেবল মুসলমানরা! তুমি মুক্তিযুদ্ধের উদাহরণ দিলে, মুক্তিযোদ্ধারা কি পাকিস্তানী ক্যাম্পে গিয়ে বলত, তোমরা এদেশ ছেড়ে চলে যাবে যত দ্রুত সময়ের মধ্যে পারো…। এ কেমন যুদ্ধ আর শত্রুর কথা বলো তো ভাই?

ছোকরা শুকনো ঢোগ গিলে বলল, আরে ভাই পড়েন না, খালি দুইটা আয়াত দেখাইয়া প্রমাণ করলে হইব?… তার চোখের সামনে ইবনে কাথিরের তাফসির থেকে পড়ছি। অস্বীকার করতে পারছে না। এ কারণেই মুখ পাংশু হয়ে গেছে। কথা না বাড়িয়ে তাই ৩ নম্বর আয়াত পড়া শুরু করলাম:

আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ হতে মহান হজের দিনে মানুষদের কাছে ঘোষণা দেওয়া হল যে, আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের সাথে সম্পর্কহীন এবং তাঁর রাসূলও। কাজেই এখন যদি তোমরা তাওবাহ কর, তাতে তোমাদেরই ভালো হবে, আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে জেনে রেখ যে, তোমরা আল্লাহকে অপারগ করতে পারবে না। আর যারা কুফুরি করে চলেছে তাদেরকে ভয়াবহ শাস্তির সু-সংবাদ শুনিয়ে দাও।” [সূরা আত-তাওবাহ্: ৩] এই আয়াতের তাফসিরে কি বলা হয়েছে চলো দেখি- (আল্লাহ মুশরিকদের সাথে সম্পর্কহীন এবং তাঁর রাসূলও) অর্থাৎ তাদের থেকেও দায়মুক্ত। এরপর তিনি তাদেরকে তাঁর নিকট অনুশোচনার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন: فَإِن تُبۡتُمۡ (কাজেই এখন যদি তোমরা তাওবাহ কর) অর্থাৎ তোমরা যে শির্ক ও গোমরাহির মধ্যে রয়েছ তা হতে যদি তোমরা তাওবা কর فَهُوَ خَيۡرٞ لَّكُمۡۖ وَإِن تَوَلَّيۡتُمۡ (তাতে তোমাদেরই ভালো হবে। আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও) অর্থাৎ তোমরা যাতে রয়েছ তাতে নিরবচ্ছিন্ন থাক فَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّكُمۡ غَيۡرُ مُعۡجِزِي ٱللَّهِۗ  (তাহলে জেনে রেখ যে, তোমরা আল্লাহকে অপারগ করতে পারবে না); বরং তিনি তোমাদের উপরে ক্ষমতাবান, তোমরা তাঁর কব্জায়, তাঁর দমন ও ইচ্ছার অধীনে রয়েছ। وَبَشِّرِ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ (আর যারা কুফরি করে চলেছে তাদেরকে ভয়াবহ শাস্তির সু-সংবাদ শুনিয়ে দাও) অর্থাৎ দুনিয়াতে লাঞ্ছনা ও শাস্তির মাধ্যমে আর পরকালে শিকল ও বেড়ির শাস্তির দ্বারা”। -এখানে দেখো সরাসরি ইসলাম গ্রহণে হুমকি দেয়া হচ্ছে। অর্থ্যাৎ তাদের ধর্ম বিশ্বাস ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করলেই তাদের সঙ্গে সমস্ত শত্রুতা মুছে যাবে। এই তাহলে শত্রুতার মূল কথা? ইবনে কাথির কি বলেছে দেখো, “এরপর তিনি (নবী) আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে ডেকে বলেন: সূরা আল-বারা’আতের (সুরা তওবার আরেক নাম) এই প্রথম ভাগটি নিয়ে বের হয়ে পড় আর কুরবানির দিন লোকদের নিকট তা প্রচার করে দাও, যখন তারা মিনায় একত্রিত হয়। ‘কোনো কাফির জান্নাতে প্রবেশ করবে না, এই বৎসরের পরে কোনো মুশরিক হজ করবে না, উলঙ্গ হয়ে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে না, যার সাথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চুক্তি রয়েছে তার মেয়াদ হচ্ছে এর নির্ধারিত সময় পর্যন্ত। …অবশেষে কুরবানির দিন আসলে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু উঠে দাঁড়ান আর লোকদের মাঝে সেই ঘোষণা প্রদান করেন যা তাকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেন: হে লোক সকল, জান্নাতে কোনো কাফির প্রবেশ করবে না, এ বৎসরের পরে কোনো মুশরিক হজ করবে না, উলঙ্গ হয়ে কেউ বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে না। আর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটে যার কোনো চুক্তি রয়েছে এর মেয়াদ হচ্ছে তার নির্ধারিত সময় পর্যন্ত। ফলে সে বৎসরের পরে কোনো মুশরিক হজ করে নি, উলঙ্গ হয়ে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করে নি। এরপর তাঁরা (দু’জন) রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ফিরে আসে। এই হচ্ছে দায়মুক্তির ঘোষণা তাদের থেকে যারা অনির্ধারিত সময়ের চুক্তির অধিকারী মুশরিক এবং যে সমস্ত মুশরিক নির্ধারিত সময় পর্যন্ত চুক্তি করেছিল’।

ছোকরাকে বললাম, মনে করো আমাদের হিন্দুপাড়াতে গিয়ে আমরা দুজন ঘোষণা করলাম, হে মুশরিকরা তোমরা তওবা করো আর শিরক করা থেকে বিরত থাকো। না হলে তোমরা জানান্নামে যাবে…। তৃতীয় কোন লোক যদি আমাদের সঙ্গে থাকে তাকে যদি বলি তাদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ চলছে, তারা আমাদের পেলে হত্যা করবে, আমরা তাদের পেলে হত্যা করব- এরকম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধাবস্থা চলছে আমাদের মধ্যে- লোকটা কি বুঝবে বলো তো? তার তো মাথাতেই ঢুকবে না এতই যদি কঠিন যুদ্ধ অবস্থা তাহলে এত সহজে কি করে তাদের মাঝে গিয়েই তাদেরই হুমকি দিতে পারছি! তুমি এবার নিজেই বলো, মুসলমানরা কেমন করে মক্কাতে গিয়ে এরকম হুমকি ধামকি দিয়ে আসতে পারল? কুরাইশরা এতই খারাপ তবু মুহাম্মদের দুইজন প্রধান সেনানীকে হজে আসতে দেখেও কিছু বলল না। যদি বলো তাদের সঙ্গে তো শান্তি চুক্তি ছিলো তাই কিছু বলেনি। তাহলে কিন্তু মুসলমানদের বিরুদ্ধেই সব দোষ গিয়ে পড়বে কারণ আয়াতে বলা হয়েছে চুক্তি শেষে কাফেরদের নিরাপত্তার দায় আর নবীর উপর থাকবে না। যদি না থাকে তাহলে কি করা হবে? চলো সরাসরি ৫ নম্বর আয়াতে চলে যাই। সেই বিখ্যাত আয়াত “তারপর (এই) নিষিদ্ধ মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেলে মুশরিকদেরকে যেখানে পাবে হত্যা করবে, তাদেরকে পাকড়াও করবে, তাদেরকে ঘেরাও করবে, তাদের অপেক্ষায় প্রত্যেক ঘাঁটিতে ওৎ পেতে বসে থাকবে। কিন্তু তারা যদি তাওবাহ করে, সলাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত আদায় করে, তাহলে তাদের পথ ছেড়ে দাও, নিশ্চয়ই আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, বড়ই দয়ালু্।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৫]

চলো এই শান্তিবাদী আয়াত সম্পর্কে ইবনে কাথির কি বলেছে দেখি: “মুশরিকদেরকে যেখানে পাও হত্যা কর” অর্থাৎ জমিনে সার্বিকভাবে, তবে হারাম (মক্কার আশে-পাশের সুনির্দিষ্ট এলাকা) এলাকায় হত্যা নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে ব্যতিক্রম করা হয়েছে। আর তা এ আয়াতের মাধ্যমে
﴿وَلَا تُقَٰتِلُوهُمۡ عِندَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ حَتَّىٰ يُقَٰتِلُوكُمۡ فِيهِۖ فَإِن قَٰتَلُوكُمۡ فَٱقۡتُلُوهُمۡۗ ١٩١﴾ [البقرة: ١٩١]
“আর তোমরা মসজিদে হারামের নিকট তাদের সাথে যুদ্ধ করো না, যে পর্যন্ত তারা তোমাদের সাথে সেখানে যুদ্ধ করে। কিন্তু যদি তারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে, তবে তোমরাও তাদের হত্যা কর।” [সূরা আল-বাকারা: ১৯১] আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَخُذُوهُمۡ “তাদেরকে পাকড়াও কর” অর্থাৎ তাদেরকে বন্দী কর, যদি তোমার ইচ্ছা হয়। তবে হত্যাও করতে পার। আর যদি তোমার ইচ্ছা হয় তবে বন্দী করতে পার। আল্লাহ তা‘আলার বাণী: وَٱحۡصُرُوهُمۡ وَٱقۡعُدُواْ لَهُمۡ كُلَّ مَرۡصَدٖۚ  “তাদেরকে ঘেরাও কর, তাদের অপেক্ষায় প্রত্যেক ঘাঁটিতে ওৎ পেতে বসে থাক” অর্থাৎ তোমরা তাদেরকে পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় থেকো না। তাদেরকে তাদের এলাকায় এবং দুর্গসমূহে খোঁজ কর এবং অবরোধ কর, তাদেরকে তাদের পথে-ঘাটে এবং চলার স্থানসমূহে তোমাদের পর্যবেক্ষণে রাখ, তাদের জন্য সংকীর্ণতা আনয়ন কর, তাদেরকে হত্যা অথবা ইসলামের প্রতি বাধ্য কর। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: فَإِن تَابُواْ وَأَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتَوُاْ ٱلزَّكَوٰةَ فَخَلُّواْ سَبِيلَهُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٞ “কিন্তু তারা যদি তাওবা করে, সালাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত আদায় করে, তাহলে তাদের পথ ছেড়ে দাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, বড়ই দয়ালু।”

মানে নামাজ পড়লে যাকাত দিলে তাদের ছেড়ে দিতে বলেছে। অর্থ্যাৎ তারা যদি মুসলমান হয়ে যায় একমাত্র তাহলেই তাদের মুক্তি। নামাজ তো আর হিন্দু পৌত্তলিকরা পড়বে না তাই না? এই আয়াতকে রেফারেন্স মেনেই কিন্তু আবু বকর ইসলাম অস্বীকরাকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছিলেন। ইবনে কাথিরের ভাষাতে “এ কারণেই আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এই সম্মানিত আয়াত এবং এ ধরণের অন্যান্য আয়াতের উপরে নির্ভর করে যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। কারণ এ আয়াতে কিছু কাজের শর্তে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে নিষিদ্ধ করা হয় তা হচ্ছে, ইসলামে প্রবেশ এবং এর আবশ্যকীয় বিষয়গুলো পালনে সচেষ্ট হওয়া”। তাহলে দেখলে তো ছোট ভাই, ইসলামে কোন জোড়জবরদস্তি নাই সে কথাও কিন্তু ঠিক না!

ছোকরা ভাঙ্গা গলা খাকড়ি দিয়ে বলল, ভাই, কাফেররা যে চুক্তি ভঙ্গ করেছিলো সে কথা তো বললেন না! তারাই তো অশান্তি সৃষ্টি করেছিলো। খামখা কি মুসলমানরা তাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েছিলো?

-আমি কিন্তু তোমার সামনেই তাফসির পড়ছি। দেখো এখানে কি লিখেছে, চুক্তির বিষয়ে ইবনে কাথির বলছে, “এই সম্মানিত আয়াতটি হচ্ছে তরবারির (জিহাদের) আয়াত যে সম্পর্কে দহ্হাক ইবনু মুযাহিম বলেন: এই আয়াতটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মুশরিকদের মাঝে সংঘটিত যাবতীয় চুক্তিকে রহিত করে দিয়েছে। সকল চুক্তি এবং সকল মেয়াদকে রহিত করে দিয়েছেন। আউফী বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এ আয়াত সম্পর্কে বলেন: সূরা আল-বারা’আহ (সূরা আত-তাওবাহ) অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে কোনো মুশরিকের কোনো চুক্তি এবং কোনো অঙ্গিকার আর অবশিষ্ট নেই। হারাম মাসসমূহ অতিক্রান্ত হওয়া, সূরা আত-তাওবাহ অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে মুশরিকদের থেকে দায়মুক্তির নির্দেশের দিন থেকে রবিউল আখির মাসের প্রথম দশ দিন এই চার মাস”। তার মানে কি দাঁড়াল? এই আয়াত নাযিল করে নবীকে পূ্র্বের সমস্ত চুক্তি বাতিলের অধিকার দিয়ে দিয়েছে!

ছোকরার মুখ থমথমে হয়ে গেছে। সে রাগতস্বরে মাটিতে সৃষ্টি রেখে বলল, তারমানে আপনি বলতে চাইছেন কুরআনে কাফেরদের ধরে ধরে হত্যার কথা বলা আছে?

-শোন ভাই, আমি তোমার সামনেই তাফসির পড়ে দেখালাম। নিজে কিছু বানিয়ে বলিনি। এখন একটা জিনিস ভেবে দেখো, মনে করো কুরআনের এই আয়াতকে কাফের হত্যার রেফারেন্স যদি কেউ দেখায় তাকে থামাবে কিভাবে? ইনবে কাথির কিন্তু দেখিয়েছেন এই আয়াতকে রেফারেন্স করেই আবু বকর ইসলাম অস্বীকরাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। তার মানে কি দাঁড়াল, মানে হচ্ছে সুরা তওবা একটা বিপদজনক সুরা। এই সুরা দুনিয়াতে রক্তারক্তি ঘটিয়ে দিতে ইন্দন যোগাবে। আজকের পৃথিবীতে আইএস, বেকো হারাম, আনসারুল্লাহ তো কুরআনের এই আয়াতগুলোই ব্যবহার করছে তাদের হত্যাগুলোকে জায়েজ করছে…।

-তারা কুরআনের অপব্যাখ্যা করছে!

-ঠিক আছে তাই মেনে নিলাম যাও। এটা কিন্তু তাওরাত, বাইবেল, গীতা বা অন্যান্য ধর্মীয় কিতাবকে সন্ত্রাসের কাজে ব্যবহৃত করা যাচ্ছে না। একমাত্র কুরআনের আয়াত নিয়ে বর্তমান বিশ্বে যত সমালোচনা তার সিকি ভাগও ঐ গ্রন্থগুলোর হয় না। আর অপব্যাখ্যার যে কথা বললে, মনে করো একটা ঠান্ডা-সর্দি-কাশির সিরাপ নেশা হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হলে কি করা হয়? সরকার ঐ সিরাপটাকে ব্যান করে দোকান থেকে উঠিয়ে নেয়- তাই না? তো কুরআনের অপব্যাখ্যায় যদি ডাইরেক্ট মানুষ খুনের মত কাজ সমাধা করা যায় তো এটা তো বিপদজনক একটা বই! তোমরা বুয়েট থেকে লেখাপড়া করেও যখন বলো ‘কুরআনের আলো ঘরে ঘরে জ্বালো’ তো এরকম বিপদজনক বইকে আমরা কেমন করে নিশ্চিন্তে ঘরে ঘরে প্রবেশ করতে দিবো যেখানে এর অর্থ বিকৃত করলে মানুষ খুন হয়ে যায়!

ছোকরা উত্তেজিতভাবে উঠে বসল। মাথার চুল খামচে ধরে ব্রাকব্রাশ করতে করতে বলল, এক কুরআন ছাড়া এইসব তাফসির টাফসির কোন কিছুই আমরা মানি না!

আমিও উঠে দাঁড়ালাম। মৃদু হেসে বললাম, তাহলে সুরা তওবার ৫ নম্বর আয়াতকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবে? ঐ আয়াতে তো কাদের সঙ্গে যুদ্ধ কি বিষয়আশয় কিছু বলা নেই।

-শোনেন ভাই, আল্লাহ যদি বলে কাফের ধরে ধরে মারতে হবে সেটাই মুমিন হিসেবে আমাদের কর্তব্য! প্রয়োজনে তাই করব…।

তাতো ঠিকই, ধর্ম পালন বলে কথা।

-শোনেন, আপনে ইসলাম মানেন না ঠিক আছে, তাই বলে ইসলামকে খারাপ বলতে পারেন না!

-অবশ্যই। আমার এত সাহস নেই যে আমি ইসলামকে খারাপ বলব!

-মিয়া ফাইজলামী করেন!

-তওবা … তওবা…

(তথ্যসূত্র: সূরা আত-তাওবার তাফসীর, আবুল ফিদা ইসমা‘ঈল ইবন ওমর ইবন কাসীর, অনুবাদক: ডা. মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান, ৮-৯-১০-১১ খন্ড একত্রে, তাফসরি পাবলিকেশন কমিটি, গুলশান, ঢাকা)

#সুষুপ্তপাঠক
4 June 2022

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted