হিন্দুদের এই অবতার অনুভূতিটা তোমরা তৈরি করে দিলে যা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক।

বন্ধু বলল, এরকম জটিল পরিস্থিতিতে আগে কোনদিন পড়িনি বুঝলে?

বললাম, কি রকম?

-বাক স্বাধীনতা!

-কেন তোমার বাক স্বাধীনতা কেউ হরণ করতে চায় নাকি?

-আরে না, সেকথা নয়। বলছি, যাকে এক পক্ষে বাক স্বাধীনতা বলি অন্য পক্ষে সেটাকেই বিদ্বেষ বলি! নিজের দ্বিচারিতা দেখে আমি নিজেই অবাক!

-ভাই তোমার এক নূপুর শর্মা নিয়ে ঘ্যানর ঘ্যানর বাদ দেও তো!

-নূপুর তো এখন বাদ। তর্ক তো এখন হিন্দু দেবী কালি পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে।

-কেন দেবীর আবার কি হলো?

-কে একজন তথ্যচিত্র বানিয়েছে যার পোস্টারে মা কালিকে বিড়ি ফুঁকতে দেখা যাচ্ছে।

-তাতে সমস্যা কি? হিন্দুরা জানে কালী দেবীর পুজাতে কি কি লাগে। তার পুজায় মদ গাঁজাও প্রসাদ হিসেবে দিতে হয়। কালী সাঁওতালদের দেবী ছিলেন। কালী কৃষ্ণসহ হিন্দু দেব দেবীকে নিয়ে লোকজ অনেক গান ছড়ায় দুষ্টুমি প্রচলিত আছে। গানে সাহিত্যে এই ভারতবর্ষের ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো বাবা মায়ের মত করে। মাকে যেমন সন্তান গালি দেয়, পাগল ছাগল বলে, কোন কাজের না, গাধা, মূর্খ... মুখে যা আসে বলে সন্তান যেমন মার প্রতি অভিযোগ তোলে, কোথাও পেরে না উঠা মানুষও ঘরে এসে মায়ের সঙ্গে যন্ত্রণা করে, সেও জানে মা ছাড়া তার গতি নেই। বাঙালির কাছে হিন্দু দেব দেবীরা কতকটা এরকম। যে কারণে হিন্দু দেব দেবী অবমাননার বিষয়টি হিন্দুরা বুঝত না। পয়গম্বর কিন্তু সেরকম কিছু নয়। খুবই সেন্টিমেন্টের বিষয়। আল্লা হচ্ছে প্রভূ। মানুষ তার দাসানুদাস।

-রাখো তোমার অধ্যাপকের লেকচার! আমি যে নূপুর শর্মার বিরুদ্ধে সরব ছিলাম এখন আমি কি করব? তুমি এখন যেগুলি বললে সেগুলি যদি বলি পাবলিক মানবে? ইন্টারনেটে একটা আঁকা ছবি পাওয়া যায়, পয়গম্ব একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে একান্তে বসে আছেন। মানে পয়গম্ব ও আয়েশা। সেই ছবি এক ছেলে ফেইসবুকে পোস্ট করার পর তাকে অন্যের ধর্ম নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করতে নিষেধ করেছি। বলেছি তুমি একটা ইসলাম বিদ্বেষী। সে জবাব দিয়েছে, আঙ্কেল, ঘটনা কি মিথ্যা, আমি কি দোষ করলাম? তাহলে দেখো, আমারও এখন কালীর পোস্টারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়?

-বেশ তো দাঁড়াও না। কে মানা করছে?

-আরে ভাই, সমস্যা হচ্ছে, এখন মনে হচ্ছে আমরা তো তাহলে বাক স্বাধীনতাকে মেরে ফেলছি।

-যা বাবা, পয়গম্বরের বিয়ের ইস্যুতে এ কথা তোমার মনে হয়নি!

-সত্যি ভাই, মনে হয়নি। এমনকি ফ্র্যান্সের যে শিক্ষক ক্লাশে বাক স্বাধীনতা বুঝাতে পয়গম্বরের কার্টুন দেখিয়েছিলো, তাকে সেই অপরাধে হত্যার পর যখন ফরাসী প্রেসিডেন্ট দেশজুড়ে পয়গম্বরের কার্টুন প্রকাশের উদ্যোগ নিলো তখনও আমার মনে হয়েছে এটা পশ্চিমা ইসলামফোবিয়ার নগ্ন রূপ! কিন্তু কাল যখন ডিডব্লু নিউজ করল মোহাম্মদ জুবায়েরকে গ্রেফতার করাটা ভারতের বাক স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ, তখন মনে হলো, নূপুর শর্মার বিরুদ্ধে মামলা হুমকি ধামকিও তো বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ। যদি নূপুর শর্মা, কালী তথ্যচিত্রের পরিচালক, মোহাম্মদ জুবায়ের, ফরাসী শিক্ষক স্যামুয়েল, শার্লি এবোদ- সকলের বাক স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়াতে হবে। এখানে স্থান কাল পাত্র দেখে তো হবে না। কিন্তু আমরা করছি ঠিক উল্টোটা। মাত্রই নূপুর শর্মার মন্ডু চটকে এখন বলছি কালীকে নিয়ে এরকম পোস্টার বানানোয় কোন দোষ নেই। কালী পুজাতে এসব জিনিস দিয়েই দেবীকে খুশি করা হয়। নূপুর শর্মার সময়ও আমার বলা উচিত ছিলো, পয়গম্ব তো ঠিকই ছয় বছরের আয়েশাকে বিয়ে করেছিলেন তা সহি হাদিসেই লেখা আছে। এটা বলে নূপুর শর্মা কোন দোষ করেনি। কেন ডয়চে ভেলে নুপুর শর্মার বক্তেব্যের পর তার বিরুদ্ধে যেভাবে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো সেটাকে বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আঘাত বলেনি? এই গণমাধ্যম কি ফরাসী ফান ম্যাগাজিনের কার্টুন আঁকার বিরুদ্ধে? নাকি কেবল ভারতের বেলায় তাদের বাক স্বাধীনতার সংজ্ঞা ভিন্ন? ওদের কথা ছাড়ো, আমি নিজে এখন দুরকম আচরণ কি করে করি বন্ধু?

-হাঃ হাঃ হাঃ...

-তুমি হাসতাছো?

-সারা বিশ্বেই একই অবস্থা! বাক স্বাধীনতার অধিকারকে রাজনৈতিকভাবে আমরা ইস্যু বানিয়ে নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশ করেছি। হিন্দুরা এখন দেবী অবমাননার জন্য তাই করতে চাইবে এতদিন নবী অবমাননার অভিযোগে যা করা হয়েছে। হিন্দুদের এই অবতার অনুভূতিটা তোমরা তৈরি করে দিলে যা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। রাধারমন দত্ত গান লিখে গেছেন, ‘মা তুই জলে না যাইও, ও হে কলঙ্কিনি রাধা, কদম গাছে উঠিয়াছে কানু হারামজাদা...’ এই গান শুনে কোন হিন্দুর কি অনুভূতিতে আঘাত লেগেছিলো? লাগেনি। সব নষ্টের মূলে তোমরা। এই ভারতবর্ষের মাটিতে পয়গম্বর সেন্টিমেন্টকে রাজনৈতিক কারণে পেলে পুষে বড় করেছো। ফরাসী বাক স্বাধীনতায় যীশু মুহাম্মদ কৃষ্ণ সবাইকে নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র আঁকা স্বাভাবিক। ফরাসীরা কেন অভিবাসীদের নাজুক নবী অনুভূতিতে পাত্তা দিতে যাবে? যে কারণে ফরাসী প্রেসিডেন্ট বিলবোর্ডে নবীর কার্টুন প্রদর্শনির ব্যবস্থা করেন যখন শিক্ষক স্যামুয়েলকে হত্যা করল জঙ্গিরা। তোমাদের নূপুর শর্মার বাক স্বাধীনতার জন্য সাপোর্ট করা উচিত ছিলো। এই দেশের গানে কৃষ্ণকে ‘হারামজাদা’ বলে গান গাওয়া জাতি কেন নূপুর শর্মার বক্তব্যে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখাবে? 

-হুম তা যা বলেছো।... আমি ভাবছি অন্য কথা।

-কি?

-আমি বরং নিজের ভুল স্বীকার করে নেই। বলি আমি ভুল করেছি। আমি নূপুর শর্মার বাক স্বাধীনতার পক্ষে। মা কালীর পোস্টারের পক্ষে। শার্লি এবোদের পক্ষে। এমনকি মোহাম্মদ জুবায়ের সে যদি বিকৃত ভিডিও না করে থাকে তাহলে আমি তারও পক্ষে... কেমন হবে?

-খুব ভালো হবে...।

~সুষুপ্ত পাঠক

#সুষুপ্তপাঠক
6 July 2022

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted