পূর্ব বাংলার সব হিন্দুই অত্যাচারি জমিদার আর ব্রাহ্মণ ছিলো! এরা মুসলমানদের অত্যাচার নিপীড়ন করেছিলো। তারই প্রতিফলন হচ্ছে নাসিরনগর, নড়াইল, কুমিল্লা হামলা...। এরকম একটা ‘নতুন ইতিহাস’ লিখতে চাইছে ‘বাঙালি মুসলমান’ জাতীয়তাবাদীরা।
এরকম ইতিহাস লিখতে চাইলে বুকের পাটা লাগবে, সেটা কি আছে যাকির তালুকদার কিংবা সলিমুল্লাহ খানদের? ৪৬-এর নোয়াখালী ম্যাসাকারের মূলহোতা কৃষক প্রজা পার্টির পীরজাদা গোলাম সরোয়ার। এই কৃষক প্রজা পার্টি কিন্তু পূর্ববঙ্গে জমিদারদের চক্ষুশূল ছিলো। সেই কৃষক প্রজার গোলাম সরোয়ার রায় চৌধুরী জমিদার বাড়িতে ‘আল্লা আকবর’ বলে তরোয়াল নিয়ে নৃশংসভাবে একটি ম্যাসাকার চালায়। এটিকে অনায়াসে রুশ বলভেশিক বিপ্লব বানাতে বুকের পাটা লাগবে! গোলাম সরোয়ারকে প্রলেতারিয়েতদের নেতা আর রায় চৌধুরীদের বুর্জোয়া বানিয়ে একটা সম্প্রদায়ের উপর ম্যাসাকারকে মুছে দিতে যে হেডেম দরকার সেটা কি যাকির তালুকদারদের আছে? কারণ এই গোলাম সরোয়ার নোয়াখালী হিন্দু সম্প্রদায়কেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিলো। গরীব কৃষক হিন্দু থেকে দোকাদার, ব্যবসাদার, উকিল, শিক্ষক, জেলে কেউ রেহাই পায়নি। হিন্দু নারীদের ধর্ষণগুলিকে জায়েজ করতে হলে অবশ্যই ‘নতুন ইতিহাসে’ এটা লিখে দিতে হবে পূর্ববঙ্গের সব হিন্দুই ছিলো জমিদার ও ব্রাহ্মণ! নইলে নতুন প্রজন্ম বর্তমান ইতিহাস ঘাটলেই দেখতে পাবে পূর্ববঙ্গে শখানেক হিন্দু জমিদার ছিলো। শুধু কি হিন্দু জমিদার? মুসলমান জমিদারও ছিলো। তারাও খাজনা আদায় করতে তালুকদারদের নিয়োজিত করত। এই তালুকদাররা সেকালে নিপীড়ণের অস্ত্র ছিলো। তাই এইসব মুসলমান জমিদার ও তাদের ক্রীড়নকদের সম্পর্কে ‘নতুন ইতিহাসে’ লিখতে হবে তারা ছিলো আসলে একেকজন কার্ল মার্কস! খালি হিন্দুরাই ছিলো খারাপ!...
রবীন্দ্রনাথের মত উত্তরাধিকারসূত্রে হওয়া জমিদার যিনি কুষ্টিয়া পতিসর শাহজাদপুরে প্রজাদের কল্যাণের জন্য সমবায়, রেশম চাষ, কৃষি ব্যাংক গঠন করেছিলেন তাকেই বানিয়ে দেয়া হয়েছে ‘অত্যাচারি জমিদার’! রবীন্দ্রথের এই ‘অত্যাচারি জমিদার’ হওয়ার কোন ইতিহাস না থাকলেও হিন্দু ও মুসলমান কমিউনিস্টরা এটা ছড়িয়ে গেছে প্রমাণহীনভাবে। মানে এই রকম ‘নতুন ইতিহাস’ লেখার চেষ্টা আরো অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছে।
অমত্য সেন দেশভাগ নিয়ে এক জায়গায় মন্তব্য করেছিলেন, দেশভাগের ফলে পূর্ববঙ্গে ভূমি সংস্কার হয়েছিলো তাতে মুসলমানরা ভূমির মালিক হতে পেরেছিলো। চিন্তা করুণ, মাত্র শখানেক জমিদার দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গে চলে গেলে সেই সুফল মুসলমানরা পেয়েছে কিন্তু বাঙালি হিন্দু যে দেশছাড়া হয়ে নিঃস্ব অবস্থায় শেয়ালদা স্টেশনে শরণার্থী হলো তার কোন কথা নেই? তারা কি সব জমিদার ছিলো নাকি সাধারণ কৃষক? গোলাম সরোয়ারদের কাছে জমিজমা হারিয়ে যারা চরম মূল্য চুকালো তাদের দেশভাগে কি লাভ হলো? এখন নাকি যাকির তালুকদারদের সময় এসেছে ‘দেশভাগের নতুন ইতিহাস’ লেখার যেখানে দেখানো হবে দেশভাগের জন্য হিন্দুরাই দায়ী! এসব ইতিহাসের রসদ হিন্দু কমিউনিস্টদের লেখা বই! কিন্তু মারা খাওয়া হিন্দু যদি দেশভাগের জন্য দায়ী হয়ে থাকে তার বেনিফেসিয়ারী তো মুসলমানরা!
বাংলাদেশে যখন হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা চলছে তখন এইসব তত্ত্ব ফেইসবুকে ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য কি? হামলাকারীদের নির্দোষ করে দেয়া না হয় হিন্দুদের প্রতি যদি সহানুভূতি চলে আসে সেটাকে ভোঁতা করে দেয়া। হামলাকারীরা জঙ্গি আর এই যাকির তালুকদাররা তাদের সাহায্যকারী! ভারতে হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে সেদেশের লেখক বুদ্ধিজীবীদের অবস্থান যেখানে সংখ্যালঘুদের পক্ষে সেখানে এখানে হিন্দুদের উপর হামলা হলে এরা বলে জমিদার অত্যাচারি হিন্দুদের নিপীড়নের ফল!
হিন্দু মানেই আর্য! বাঙালি নাকি কোনদিন আর্যদের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি! কোন বাঙালি সেটা? যে বাঙালি পহেলা বৈশাখকে হিন্দুদের অনুষ্ঠান বলে বয়কট করে আরবিকে জান্নাতের ভাষা বলে মাথার উপর স্থান দেয়? অনার্য কালি-শিব আর্য দেবতাদের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে। আহমদ ছফার লেখা কোট করে যখন যাকির তালুকদার লেখে, বাংলাদেশের ভূমিপুত্র হচ্ছে বাঙালি মুসলমানরা’ তখন এই দেশে মুফতি জসিমউদ্দিন রাহমানিকে আর আলাদা করে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। নড়াইল নাসিরনগর কুমিল্লায় যারা হিন্দুদের উপর হামলা চালিয়েছে তার মানে হচ্ছে ভূমিপুত্ররা বহিরাগত জমিদার ব্রাহ্মণ আর্য বংশদের উপর হামলা চালিয়েছে! বাঙালির মুসলমানের পূর্ব পুরুষ মাত্র সাত পুরুষ আগেই ছিলো হিন্দু! এদেশের পঞ্চাশ হাত মাটি খুড়লে এখনো মূর্তি মিলবে। পুজার সরঞ্জাম পাওয়া যাবে। এরা কেউ জমিদার ব্রাহ্মণ ছিলো না। বখতিয়ার খিলজির বাহিনী এসে এইসব গরীব হিন্দু নারীদের রেপ করে গিয়েছিলো। সেই রক্ত এই জাতিতে বইছে। এদের কথা ও ইতিহাসে সেই টান আছে। থাকবে। সাতশো বছরের মুসলিম সাম্রাজ্যবাদ ভারতের বুকে শাসন করে গেছে তা নিয়ে এদের কোন কথা নেই। ইংরেজ আমলের হিন্দু জমিদারই হচ্ছে এদের সমস্যা। অথচ এরা অশিক্ষিত থেকে যেত যদি না পূর্ববঙ্গে হিন্দু জমিদাররা নিজেদের গ্রামে বাপ-মার নামে স্কুল না খুলত। ড. আহমদ শরীফ স্বীকার করেছেন এইসব স্কুল খোলার ফলে বাঙালি মুসলমানদের প্রথম ইংরেজি শিক্ষিত জেনারেশন বের হতে পেরেছিলো। যাকির তালুকদারদের দোষ নেই, ভারতীয় হিন্দু কমিউনিস্টরা ইতিহাস লেখার নামে তাদের মার্কসবাদী দর্শনের প্রভাবে যাদের যাদের শত্রু, শত্রুর শত্রু বন্ধু করতে গিয়ে তাদের বিশ্লেষণ এরকম একচোখা রয়ে গেছে। অনেক বড় ক্ষতি করে গেছে তারা!
-সুষুপ্ত পাঠক
21 July 2022
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................