হিন্দুদের দেশত্যাগ রুখে দেয়া যায়নি
প্রিয়া সাহার ৩.৭০ কোটি হিন্দু কমে যাওয়ার গণিতটা মিলিয়ে দিয়েছিলাম তার দাবির পরপরই৷ আবারো মিলাচ্ছি—
১৯২১ সালে বাংলাদেশে হিন্দু ছিল ৩০.৬০%
যদি এই হার বজায় থাকতো তাহলে আজ হিন্দু থাকতো ১৬.৫২x৩০.৬০%= ৫.০৫ কোটি!
এখন আছে= ১.৩১ কোটি!
নাই হয়েছে= ৩.৭৪ কোটি!
এতো সরল নয় সবকিছু৷ ওই অনুপাতে থাকলে মোট জনসংখ্যাও ৩০.৬০%-৭.৯৫% = ২২.৬৫% বেড়ে যেতো৷ তাতে হিন্দুর সংখ্যা আরো বাড়তো৷ আবার ১৯০১ সালে হিন্দু ছিল ৩৩.০০%৷ সেটা ধরলে আরো বাড়তো৷ কিন্তু জন্ম হার মুসলিমদের বেশি তাই হিন্দু জনসংখ্যার হার সামান্য কমতো৷ তাতে প্রিয়া সাহার ওই মন্তব্যকে বাতিল করতে পারিনি৷
হিন্দুদের দেশত্যাগ একটি ধারাবাহিকতা। ১৯০১ সালের ৩৩ ভাগ হিন্দু কিভাবে আজ ৮ ভাগের নিচে নেমে আসলো? ভারত ভাগের দাঙ্গা এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সবচেয়ে হিন্দু বেশি দেশ ত্যাগ করেন। ১৯৪১ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত (২৮.০০-২২.০৫) প্রায় ৬ ভাগ এবং ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত শতকরা হারে ৫ ভাগ (১৮.৫০ - ১৩.৫০) হিন্দু কমে যায়। এরপর একেবারেই ধারাবাহিকভাবে কমেছে। এটা কোন দল কখন ক্ষমতায় তার উপর নির্ভর করেনি। দেশের অবস্থা যতই ভাল হোক আমার প্রিয় কমল চন্দ্র মোদক স্যারের পক্ষে কি দেশে থাকা সম্ভব ছিল? তিনি ও তার স্ত্রী ছিলেন চাকুরিজীবী। তারা বহু আগেই পরিকল্পনা করেন দেশত্যাগের। তার এক সন্তানকে পাঠিয়েছিলেন ইউরোপে, আরেক ছেলে লেখাপড়া করে ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়ে ওখানেই চাকুরি করছেন। এখন অবসর নিয়ে তারা স্বামী-স্ত্রী কি করবেন? সহজ হিসাব ভারতে চলে যাবেন। এ ধরনের যাওয়াটা সরাসরি সাম্প্রদায়িক কারণে না ঘটলেও পেছনে ঠিক সাম্প্রদায়িকতাই রয়েছে। ভবিষ্যতে সম্মানহানির আশঙ্কা থেকেই তারা অতীতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এখনো সম্মানজনক চাকুরি করছেন এমন অনেককেই জানি যারা ভারতে যাওয়ার জন্য সবকিছু ঠিক করছেন, অবসরে গেলেই দেশ ছাড়বেন। কিছু বড় ব্যবসায়ীকেও দেখছি তারা ভারতে জায়গাজমি কিনেছেন, বাড়ি করেছেন, নাগরিক হয়েছেন, রেশনকার্ড করেছেন। এই চলে যাওয়াটা এখন আরো ক্ষতির। যারা যাচ্ছে তারা শিক্ষিত সংস্কৃতিমনা পরিবার। উচ্চ বর্ণের সিংহভাগ হিন্দুই দেশ ত্যাগ করেছে দুই স্বাধীনতার আগেই। এদেশে ক্ষত্রিয় হিন্দু নাই। বৈশ্যদের মধ্যে যারা ভাল চাকুরি করছেন তাদের মধ্যে কেউ কেই, ভাল ব্যবসা করছেন তাদের কেউ কেউ যাওয়ার চেষ্টা ওই পূর্বসিদ্ধান্তের কারণেই করেন। কবছর আগে বিক্রমপুরের ভাগ্যকুলের একদা বড় ব্যবসায়ী ঈশ্বর পালের পরিবার দেশত্যাগ করলেন। একারণে তারা তাদের সমূদয় সম্পত্তি বিক্রি করে সেই টাকা ভারতে পাচার করে নিয়ে গেছেন। তারাও পূর্ব সিদ্ধান্তের কারণেই চলে গেলেন। যদিও সেই টাকা পাওয়া নিয়েও বিস্তর কথা শুনি৷
একাত্তরে যারা বাড়িঘর ছেড়ে ভারতে গিয়েছিলেন তাদের অনেকে স্বাধীনতার পরে এসে দেখলেন বাড়িঘর বেদখল৷ তারা ওই বাড়িঘর দখলে নিতে না পেরে আবারো ফিরে গেছেন৷ সাতচল্লিশের দাঙ্গার পরেও এমনটা হয়েছে৷ ঈশ্বর পালের পরিবারে একজন দীর্ঘাঙ্গী সুন্দরী কিশোরী ছিল৷ কলকাতাতেই থাকতেন, মাঝেমধ্যে আসতেন৷ একবার বাংলাদেশে এসে বখাটেদের কবলে পড়েছিলেন৷ পরিবারের নারীদের সম্মানহানীর আশঙ্কা থেকেও অনেকে চলে গেছেন৷ দেশে বারবার দাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে৷ সেই আতঙ্কে বা সহিংসতার শিকার হয়েও অনেকে দেশ ছেড়েছেন৷ দেখা গেল এক হামলায় কেউ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিন্তু পরে আর সংকটে পড়েননি৷ কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার একটা প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন সেটাতো আর থামানো যায় না৷
১৯৮১ থেকে পাঁচটি আদম শুমারী হয়েছে৷ ১৯৮১ তে হিন্দু ছিল ১২.১৩% আজ আছে ৭.৯৫%! মাঝে এরশাদ শাসনামলে হিন্দু কমে ১৯৯১ সালে ১০.৫১% এ নেমে আসে৷ এরপরে ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালে ১০.৫১% থেকে ৮.৫৪% এ নেমে আসে৷ এর পরের দশ বছরে (২০০১-২০১১) হিন্দুদের দেশ ত্যাগ ছিল খুব কম৷ এই এক দশকে কমে মাত্র ০.০৪%! মুসলিম জন্মহার বেশি বিবেচনা করলে এটা ইগনোরও করা যায়৷ সরকারের পরিসংখ্যান দপ্তর বারবার বলছিলেন হিন্দুদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে উল্টো৷ আমরাও বিশ্বাস করেছিলাম৷ কিন্তু গত এক দশকে জরিপ ভিন্ন বার্তা দিল৷ আবার ফিরে এলো অতীত! ১৯০১ সাল থেকে এক দশকে ৩৩% থেকে ১.৫০% কমা মানে হল শতকরা ৪.৫৪ ভাগ কমা আর ৮.৫০% থেকে ০.৫৫% কমা মানে হল শতকরা ৬.৪৭ ভাগ কমা৷ অর্থাৎ হিন্দ কমার হারে আমরা গত শতাব্দীর প্রথম দশককে অতিক্রম করলাম!
গত এক দশকে একের পর এক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে কিন্তু তেমন প্রতিবাদ হয়নি৷ অনেক ক্ষেত্রেই ফাঁসানো হয়েছে রসরাজ বা ঝুমনদের৷ হৃদয় মণ্ডল বা স্বপন বিশ্বাসদের অপমানের কোন দৃশ্যমান শাস্তি হয়নি৷ অর্থাৎ হিন্দুদের এমন কোন বার্তাই দেয়া হয়নি যাতে তারা আস্থা অর্জন করতে পারে৷ ফলে হিন্দুর দেশত্যাগ যে থেমে যায়নি এবং নিরবে তা চলেছে বিভিন্ন স্থান থেকে তারই প্রমাণ এই জরিপ৷ আস্থার জায়গা তৈরি করতে হলে তো অপরাধীদের শাস্তি দিতে হবে৷ ঝুমন দাশ ও হৃদয় মণ্ডলদের আটক করলে ভিন্ন বার্তাই দিবে৷ হিন্দুদের দেশত্যাগ চলতেই থাকবে৷
লেখক: Mojib Rahman
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................