তেভাগা আন্দোলন’ নিয়ে লিখতে বসে দেখলাম এটা কেবল বর্গা চাষীদের অধিকার আন্দোলন নয়, এই আন্দোলনের পেক্ষাপট থেকে দেশভাগের আসল কারণটিও জানা যায়।

‘তেভাগা আন্দোলন’ নিয়ে লিখতে বসে দেখলাম এটা কেবল বর্গা চাষীদের অধিকার আন্দোলন নয়, এই আন্দোলনের পেক্ষাপট থেকে দেশভাগের আসল কারণটিও জানা যায়। দেশভাগ যে কেবলই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের কারণেই ঘটেছিলো তেভাগার সামাজিক অবস্থা থেকে জানা যায়। এখান থেকে দেশভাগের জন্য হিন্দু জমিদাররের অত্যাচারকে যারা বড় করে দেখান সেই দাবীটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়। কেননা মুসলিম লীগ তেভাগা আন্দোলনের বিরুদ্ধে গিয়ে জোতদারদের পক্ষ নেয়। কাজেই অমর্ত্য সেনের যে বক্তব্য- দেশভাগের ফলে পূর্ববঙ্গে ভূমি সংস্কার সম্ভব হয়েছিলো সেটি যে মিথ্যা তাও প্রমাণ করা যায়। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান জোতদাররাই জমির মালিক থাকে। তারাই শোষন করে সাধারণ কৃষকদের। যেসব কমরেডরা দেশভাগের কারণ হিসেবে পূর্ববঙ্গের গরীব কৃষকদের পাট বেচার টাকায় হিন্দু জমিদারদের বিলাস ব্যাসন ইত্যাদি বলে বুঝাতে চান পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানে যোগ দিয়ে হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রলেতারিয়েত পূর্ববঙ্গীয় মুসলমান কৃষকদের জয় হয়েছিলো, সেটা একটা পরিকল্পিত মিথ্যাচার। 


সে বিষয়ে কিছু প্রমাণ দেয়াসহ কমিউনিস্টরা তেভাগা কৃষক আন্দোলনকে কি করে তাদের ঐতিহাসিক আহাম্মকী চরিত্রের কারণে ব্যর্থ করে দিয়েছিলো সেটাও দেখানোর চেষ্টা করব।

১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজরা এদেশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে সামন্তবাদী জমিদার প্রথার সৃষ্টি করে। অর্থাত জমির মালিকানা কৃষকের থেকে কেড়ে নিয়ে জমিদারদের উপর তুলে দেয়া হয়। ইংরেজ আর কোন ঝামেলায় থাকল না। তাদের হয়ে খাজনা নিবে জমিদার। জমিদার মরেধরে কিভাবে খাজনা আদায় করবে সেটা তাদের ব্যাপার। ইংরেজ আর লাঠি হাতে নিলো না। এটা সে জমিদারদের উপর দিয়ে বসে বসে মুনাফা গুণল। জমিদার আবার এত এত জমি দেখাশোনা খাজনা আদায় করতে কিছু রক্তশোষক মধ্যস্বত্ত্বভোগী সৃষ্টি করল ‘তালুকদার’ ‘হাওলাদার’ যাদের কাজ ছিলো জমিদারের জমির পত্তন নিয়ে খাজনা আদায় করে সে কিছু নিয়ে জমিদারকে পুরোটা বুঝিয়ে দিতো। বর্গা চাষীদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। শিল্পী সোমনাথ হোর তার ‘তেভাগার ডাইরি’ বইতে লিখেছেন, বর্গা চাষীদের প্রতিদিনের খাবারে আমিষ প্রোটিনের মারাত্মক ঘাটতি। ভাত আর কোন একটি শাক পাতা বাজাই রোজ তাদের খাবার। সেই ভাতও বছরের একটা সময় জোটে না! আধপেটা খেয়ে যে জমির ফসল সে ফলে তার পুরোটাই যায় জোতদারের গোলায়। কর্জ করা ধান সুদে আসলে হিসাবের ফাঁকিতে কৃষক পরিবার দেনার দায়ে জোতদারের ক্রীতদাসে পরিণত হয়। ফলে একসময় ক্ষোভ থেকে শুরু হয় আন্দোলন। নানা পর্যায়ে দাবী উঠে বর্গাচাষীরা ফসলের তিনভাগের দুইভাগ নিবে। কৃষকের খোলানে ধান উঠানো হবে। এই দাবীতে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৪৬ সালে পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের ১৯টি জেলায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। প্রাদেশিক কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক ভবানী সেনের নেতৃত্বে কয়েকটি দাবী নিয়ে কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়। এই আন্দোলন পুরোদমে শক্তিশালী হয়ে উঠে একদম মাঠের কৃষকদের হাতে। নেতৃত্ব দিতে থাকে কমিউনিস্টরা। তাদের আহাম্মকীর কারণে এই আন্দোলন যে আইনে পরিণত হতে পারেনি সেকথা খোদ কমরেড ভবানী সেনই বলে গেছেন এভাবে- “যখন খসড়া বর্গাদার বিল প্রকাশিত হয়, আমরা তখন আত্মসন্তুষ্ঠ এবং অসতর্ক হয়ে পড়ি, কারণ আমরা ভেবেছিলাম জয় সমাসন্ন। তাই আন্দোলন উচ্চতর পর্যায়ের দিকে অগ্রসর হতে থাকা সত্বেও সাংগঠনিক পত্রে ও ব্যবস্থা নেওয়া হয় নাই। পরবর্তীতে কৃষক সভায় সাংগঠনিক পত্রে পর্যালোচনা করে বলা হয় যে, আন্দোলন দ্বিতীয় পর্যায়ে তেভাগা বিলের খসড়া গেজেট প্রকাশিত হওয়ার পর জোতদারদের খামার হইতে ধান আনার দিকে না যাইয়া আমরা যদি তেভাগা বিল আইনে পরিণত করার জন্য জনমত গঠন করার কাজে সকল শক্তি নিয়োগ করিতাম তাহা হইলে সম্ভবত: তেভাগা বিলকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা জোতদারদের পক্ষে সম্ভব হইত না” (অনন্যসাধারণ তেভাগা সংগ্রাম, শেখর দত্ত)।

অর্থাত, ভবানী সেন নিজেই বলছেন কমিউনিস্টরা সেসময় রোমান্টিক বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর ছিলো! একেকজন নিজেকে লেনিন চে গুয়েভারা কল্পনা করে জোতদারদের খামারে হামলা চালিয়ে ধান লুট করার দিকেই মনোযোগ দিয়েছিলো। অথচ তখন পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার তেভাগা বিলটিকে ধামাচাপা দিয়ে সফল হয়েছিলো কমিউনিস্টদের গ্রামে গ্রামে এই লুটপাটের চিত্রকে কাজে লাগিয়ে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ বাহিনীকে নিয়োগ করে আন্দোলনকারী কৃষকদের উপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। মুসলিম লীগ সরকার জনগণকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছে এক শ্রেণীর ডাকাতদের কারণে গ্রামে ধান লুট ও ডাকাতী বেড়ে গেছে। দ্বিতীয় আরেকটি কারণে তেভাগা আন্দোলন নিয়ে পুরো জাতির কোন আগ্রহ তৈরি হয়নি কারণ দেশভাগ ও তথনকার উত্তপ্ত রাজনীতিতে তেভাগা আন্দোলন নিজেকে সংম্পৃক্ত করতে পারেনি। কমিউনিস্টরা ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের লড়াই’ বলেও মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করে জনগণ থেকে পরিত্যাক্ত হয়েছিলো। বস্তুত যে কোন মেহণতি মানুষের অধিকার আন্দোলনের সর্বনাশ করতে তারা ওস্তাদ! গার্মেন্টস কর্মীদের নিয়ে গত চল্লিশ বছর কমিউনিস্টরা আন্দোলন করে নিজেরা সম্পদের মালিক হয়েছে আর এইসব শ্রমিকদের পথে বসিয়েছে।

তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ঐতিহাসিক আরো একটি সত্যকে মনে করিয়ে দেয় যে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস দল দুটি চালাতো মূলত জমিদার জোতদাররা। তারাই পরবর্তীকালে পাকিস্তান ও ভারতের ক্ষমতায় বসে। কিন্তু পূর্ববঙ্গে মুসলমানরা দেশভাগের দায় হিন্দুদের উপর চাপাতে যে সামাজিক পরিস্থিতি চিত্রণ করতে চায় সেখানে বুঝানো হয় হিন্দু জমিদাররা পূর্ববঙ্গের সংখ্যালঘু হলেও গরীব মুসলমান কৃষকরা ছিলো সংখ্যাগুরু। এরাই শোষণ করত মুসলমান কৃষকদের। দেশভাগের দাবীর প্রেক্ষাপট বুঝাতে এই ইতিহাস এখানে প্রচলিত। কিন্তু ইতিহাস বলছে দেশভাগের পরও চলমান তেভাগা আন্দোলনে মুসলিম লীগ জোতদারদের পক্ষ নিয়ে কৃষকদের উপর পুলিশি নির্যাতন জেল-জুলুম চালিয়ে নরক করে তুলেছিলো। 

তেভাগার কথা আসলে নাচোলের ‘রানী’ খ্যাত ইলা মিত্রের কথা আসবেই। আমার প্রশ্ন এই নারী কমেরড কেন শেষ জীবনে কোলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নিলেন? জমিদার বাড়ির বউ হয়েও সাঁওতাল কৃষকদের সঙ্গে একই ঘরে বিছানায় কাটিয়ে তাদের একজন হয়ে উঠা ইলা মিত্রকে অকথ্য নির্যাতন করে প্রায় মেরে ফেলেছিলো দ্বিজাতিতত্ত্বের সৈনিকরা। (পড়তে পারেন: ইলা মিত্র, মালেকা বেগম, প্রকাশ ১৯৮৭)। মুসলিম লীগের সরকার জেলখানাতে ইলা মিত্রের উপর অকথ্য নির্যাতন করায় চিকিত্সার জন্য প্যারোলে মুক্ত হয়ে কোলকাতায় চলে যান ইলা মিত্র এবং সেখানে গিয়ে ভারতের নাগরিত্ব নেন। কেন ইলা মিত্র তার নিজের দেশে আর থাকতে পারলেন না? গরীব কৃষকদের ব্রাহ্মণবাদী জমিদারদের থেকে মুক্ত করাই যদি পাকিস্তান আন্দোলন হয়, তাহলে সেই কৃষকদের জন্য জীবনবাজী রাখা ইলা মিত্রের ঠাঁই কেন হলো না পাকিস্তানে? তিনিও কেন যোগেন মন্ডলের মত পালালেন? মজার বিষয় হচ্ছে ইলাম মিত্র বাকী জীবন কোলকাতাতেই কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে কাজ করে গেছেন। দেশভাগ ও সেখানকার মুসলিম লীগের হিন্দু বিরোধী রাজনীতি নিয়ে কোন বইপত্র লিখেছেন তার কোন প্রমাণ নেই।

বলাই বাহুল্য তেভাগা আন্দোলন সফল হয়নি। তিন ভাগের দুই ভাগ বর্গা চাষী আজো পায়নি। দেশভাগের যৌক্তিকতা বুঝাতে এক কমরেড একবার ফেইসবুকে দাবী করেছিলো, পূর্ববঙ্গের গরীব মুসলমান কৃষকের পাট বেচা টাকায় আমরা কেন শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন বইয়ে পড়তে যাবো? অথচ মুসলিম লীগও ছিলো মুসলমান জমিদার জোতদারদের দল। তারাই তেভাগা হতে দেয়নি। আহাম্মক কমিউনিস্টদের মাথামোটা সিদ্ধান্ত সেটিকে আরো সহজ করে দিয়েছিলো মাত্র...।

Written by : সুষুপ্ত পাঠক

#copyrightfree

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted