আহুর মাজ়দা কে? তার প্রকৃতিই বা কিরূপ?

 আহুর মাজ়দা কে? তার প্রকৃতিই বা কিরূপ? 

☫ যে সময়ে ইরানের মেয়েরা তাদের হিজ়াব খুলে আগুনে পোড়াতে ব্যস্ত, সে সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় অগ্নিপূজক জরাথ্রুস্টীয় ধর্মের কথা স্মরণ করছে  
 
 
 
আমরা সবাই জানি যে, ইরানে এই মুহূর্তে কি ঘটে চলছে। প্রায় ৮৩ শহরে হিজাব বিরোধী আন্দোলনের আগুন জ্বলছে। সর্বত্র মেয়েরা হিজাব খুলে ফেলে তা আগুনে ফেলে পোড়াচ্ছে। যারা ইরানের রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তাদের মতে, এই আন্দোলন শুধুমাত্র হিজাবেই বা নারী অধিকারে সীমাবদ্ধ নেই — এতে জরাথ্রুস্টীয় অ্যাঙ্গেলও আছে। বহু ইরানীয় গোপনে গোপনে জরাথ্রুস্টীয় হয়ে গেছেন ইসলামের বীভৎস রূপ দেখে। তারা ইরানের বর্তমানের 'ইসলামিস্ট' সরকারকে যেমন সহ্য করতে পারছেন না, তেমনই তারা চাইছেন পুরো দেশের মানুষ তাদের পূর্বপুরুষের ধর্মে ফিরে আসুক। হিজাব বা অন্যান্য ইসলামিক পোশাক পোড়ানোর সাথে তারা পবিত্র জরাথ্রুস্টীয় মন্ত্রও পাঠ করছে, যা জরাথ্রুস্টীয় ধর্মের প্রধান উপাস্য আহুর মাজ়দার সাথে সম্পর্কিত। আহুর মাজ়দার প্রতীক হিসাবে অগ্নিপূজার সম্পর্ক আছে। ইসলামের অনুপ্রবেশের পূর্বে প্রত্যেক ইরানীয়রা আহুর মাজ়দার উপাসনা করত।  
 
বিভিন্ন জায়গায় একটা 'কমন' জিনিস দেখা যাচ্ছে। রাস্তার মাঝখানে আন্দোলনকারীরা সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দিতে হাততালি দিচ্ছে, নাচছে। এমন সময়ে একটা বা দুটো মেয়ে নাচতে নাচতে একটি বৃত্তাকার স্থানে নাচতে নাচতে এসে পড়ছে, তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে দুহাত তুলে কি যেন চিৎকার করে উঠল, তারপরেই হিজাব আগুনে ফেলে দিয়ে মন্ত্র পাঠের মত ভঙ্গিতে কি যেন আউড়ে চলছে। এরকম দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি সর্বত্র হয়ে উঠছে। ইরানে ১৬ সেপ্টেম্বর এক ২২ বছর বয়স্কা মাহসা আমিনির মৃত্যুতে পুরো ইরানের যুবা সমাজ জ্বলে উঠেছে। মাহসা সেদেশের 'শরিয়া পুলিসের' হাতে নিহত হয়েছিল সামান্য হিজাব ঠিকঠাক ন পড়ার কারণে।  
 
নিচের টুইটে আজিহাঁ (@AjiHaan) নামে একজন লিখেছেন, "দেখুন! পারস্যের লোকেরা আবার অগ্নিপূজা শুরু করেছে। এই অগ্নিপূজা যে আহুর মাজ়দার প্রতীক তা সবাই অল্পবিস্তর জানেন। এইভাবে ইরানের ইতিহাস ধীরে ধীরে বদলাবার দিকে এগোচ্ছে।" 
 
পরের টুইটে দিল্লির বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র (@KapilMishra_IND) লিখেছেন, "আমাদের সাহসী ইরানীয় ভগিনীরা দেখুন কিভাবে হিজাব, বোরখা পোড়াচ্ছে! আর স্বাধীনতার দাবি তুলছে। এইভাবে তারা প্রাচীন পারস্যের ধর্ম জরাথ্রুস্টীয় ধর্মের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।"  
 
আরেকটা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে জনৈক পুলিস একটি হিজাব পোড়াতে ব্যস্ত মেয়েকে পেটাচ্ছে, তা দেখেই ক্ষিপ্ত লোকজন পাল্টা মারতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছে।  
 
নিচের টুইটে আহুর মাজ়দা (@Dishaharaaa) নামে একটা টুইটার আকাউন্ট থেকে লেখা হয়েছে, "হে ইরানীয়রা! এসো পারস্যের প্রাচীন উপাস্য আহুর মাজ়দাকে আরাধনা পুনরায় শুরু করো!" 
 
এইভাবে ইরানে যেমন হিজাব পুড়িয়ে একটা অত্যাচারের প্রতীক ধ্বংসের চেষ্টা চলছে, অনুরূপ ভাবে জরাথ্রুস্টীয় ধর্মকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে ধীরে ধীরে। ইরানের যুবা সম্প্রদায় চাইছেন ইসলামিক সভ্যতাকে ধ্বংস করে সেখানে জরাথ্রুস্টীয় সভ্যতাকে ফিরিয়ে আনতে। বহু স্থানে ইরানীয়রা বাড়িতে, দেওয়ালে লিখে রাখছেন, 'ইসলাম চাই না', 'আমরা সবাই জরাথ্রুস্টীয়', 'আমরা আর্য, বর্বর সেমিটিক নই,' 'ইরানে ইসলামের মত পশ্চাৎপদী মতাদর্শের স্থান নেই' ইত্যাদি।   
 
• আহুর মাজ়দা কে? তার প্রকৃতিই বা কিরূপ? 
 
প্রাচীন জরাথ্রুস্টীয় ধর্ম অনুসারে ইনি সর্বোচ্চ দেবতা। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, জরাথ্রুস্টীয় ধর্মকে অনেকে একেশ্বরবাদী মনে করলেও, বাস্তবে তা ঠিক নয়। জরাথ্রুস্টীয় ধর্মে একাধিক দেবদেবীর অস্তিত্ব আছে। প্রাচীন পারস্যের মানুষ বিশ্বাস করত যে, ইনি সৃষ্টির দেবতা, ইনি মানুষের শুভচিন্তক। প্রাচীন পারস্যের ভাষায় তাকে হোরমাজ়াদ বলা হত, যার অর্থ প্রজ্ঞাময় পরমেশ্বর। তার পুত্র হচ্ছে অগ্নি, সে কারণে তাকে ও তার পুত্রকে স্মরণে রাখতে অগ্নিপূজার প্রচলন শুরু হয়।  আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব সপ্তম শতকে জরাথ্রুস্টীয় ধর্মের প্রবর্তক জরাথ্রুস্টের জন্ম হয়।  
 
• জরাথ্রুস্টীয় ধর্মের উত্থান ও পতন 
 
৫৫০ খৃষ্টপূর্ব নাগাদ সাইরাস দ্য গ্রেটের হাতে আখেমিনি সাম্রাজ্যের সূচনা ও জরাথ্রুস্টীয় ধর্মের উত্থান, দুইই একসাথে ঘটে। ইহাই ছিল আখেমিনি সাম্রাজ্যের (৫৫০-৩৩০ খৃষ্টপূর্ব) রাষ্ট্রধর্ম। এরপর এক এক করে পারথিয়ান (২৫৬ খৃষ্টপূর্ব থেকে ২২৬ খৃষ্টাব্দ) এবং সাসানিয় (২২৬-৬৫২) সাম্রাজ্য পারস্যের ক্ষমতায় আসে। দুই রাজবংশের অধীনে জরাথ্রুস্টীয় ধর্ম ছিল রাষ্ট্রধর্ম।  
 
এরপর ইরানে আরব সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন শুরু হয়। আরব সাম্রাজ্যবাদীদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে প্রায় ৯০% পারস্যের মানুষ ধর্মান্তরিত হয়ে যায়। যারা করে নি, তারা নির্যাতনের শিকার হতে থাকে। তাদের ধর্মস্থান ভেঙ্গে দেওয়া হতে থাকে, জিজিয়া কর চাপিয়ে দেওয়া হয়, প্রকাশ্যে ধর্মাচরণ পালন নিষিদ্ধ হয়।  
 
অত্যাচার থেকে বাঁচতে বহু ইরানীয় জরাথ্রুস্টীয় ধর্মাবলম্বী ভারতে পালিয়ে আসেন। এইভাবে সেখানে জরাথ্রুস্টীয় ধর্মের পতন ঘটে। বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ২% জরাথ্রুস্টীয় ধর্মাবলম্বী বলে অনুমান করা হয়।  
 
• হিজাব বিরোধী আন্দোলন ও অগ্নিপূজার প্রত্যাবর্তন 
 
হিজাব বিরোধী আন্দোলনে যারা অংশ নিয়েছেন তাদের অনেকেই প্রকাশ্যে নিজেদের জরাথ্রুস্টীয় ধর্মাবলম্বী ঘোষণা করেছে, মজহবী নয়। তাদের মতে, ইরানের মত সভ্য সংস্কৃতির দেশে ইসলামের মত একটি বর্বর সংস্কৃতির কোনও জায়গা নেই, থাকতে পারে না। তাদের মতামত স্পষ্ট — তারা চায় ইরান আবার জরাথ্রুস্টের দেশ হিসাবে পরিগণিত হোক, শিয়া ইসলামের দেশ নয়। তারা অগ্নিপূজা করে সে ইঙ্গিত দিচ্ছেন। তারা এও জানিয়েছেন, ইরানের মাত্র ৪০% মানুষ প্রকৃত ইসলাম মজহব পালন করেন; বাকিরা গোপনে বা প্রকাশ্যে জরাথ্রুস্টীয় ধর্ম পালন করেন। আন্দোলনকারীরা নিঃসন্দেহ যে, ইরানে 'মোল্লাতন্ত্রের' পতন ঘটলে ৯৯% মানুষ জরাথ্রুস্টীয় হয়ে যাবেন।  
 
টুইটারে @dronestrike নামে একজন লিখেছেন, "অবশেষে আহুর মাজ়দা সেমিটিক প্রতীক হিজাব গিলে নিচ্ছে!" 
 
প্রবাসী ইরানীয় সাংবাদিক মাহইয়ার তৌসি (@MahyarTousi)  লিখেছেন, "বহু জায়গায় স্লোগান উঠছে 'ইসলাম  নিপাত যাক', 'ইরানে ইসলামের জায়গা নেই', 'আমরা সবাই গর্বিত জরাথ্রুস্টীয়' ইত্যাদি। ইরানীয়রা কারুর হস্তক্ষেপ ছাড়াই ইসলামিক প্রজাতন্ত্র নামে তামাশাকে হঠাতে চায়।" 
 
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, যে মাহসা আমিনির মৃত্যুর জেরে ইরান এমন অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে, সেই মাহসা আমিনির পিতাও মেয়েকে ইসলামিক প্রথায় সমাধিস্থ করতে রাজি হন নি, তার বদলে তিনি জরাথ্রুস্টীয় প্রথায় ডেড টাওয়ারে মেয়েকে রেখেছেন। তিনি প্রকাশ্যেই ইমামদের ভর্ৎসনা করে বলেছেন, "তোমাদের ইসলাম আমাদের মেয়েকে হত্যা করেছে, এখন ওর জন্য প্রার্থনার নাটক করতে এসেছ? তোমাদের কি লজ্জাবোধের বালাই নেই? তোমরা দুগাছি চুলের জন্য একে হত্যা করেছ! দরকার নেই অমন ধর্মের, যেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতা পাপ হিসাবে গণ্য হয়। আজ থেকে আমরা ইসলাম ত্যাগ করলাম, জরাথ্রুস্টীয় ধর্ম গ্রহণ করছি।" 
 
সব মিলিয়ে ইরান তাই ধীরে ধীরে ইসলামের সমাধিক্ষেত্র হয়ে উঠছে, তা না বললেও চলে।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted