ইউরোপে প্রথমে অন্ধকার যুগ কাটিয়ে আসে রেনেসাঁ।

মুক্তির পথ একটাই!

আমরা বহুভাবেই ধর্মভিত্তিক সমাজের চিত্র আঁকছি। এর বহুবিধ সংকট নিয়েও কথা বলছি। আরো অসংখ্য চিত্র ও সংকট রয়েছে৷ আমরা চাই এর থেকে উত্তরণ। একটা ভাল উদাহরণ পৃথিবীতে রয়েছে। যে মৌলবাদ শব্দটি এসেছে খৃষ্ট ধর্ম থেকে, যে খৃস্টানরা ধর্মোন্মাদ হয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছে বিশ্বজুড়ে। তাদের তাণ্ডবে বহু জনপথ, মানুষ ও বিজ্ঞানচিন্তা বিপর্যস্থ হয়েছে। সেই ইউরোপ, সেই খৃস্টান সমাজ আজ মৌলবাদ মুক্ত হয়েছে। 

ইউরোপে প্রথমে অন্ধকার যুগ কাটিয়ে আসে রেনেসাঁ। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দী হল ইউরোপের মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে পদার্পনের মধ্যবর্তী সময়। এটাই রেনেসাঁকাল। যদিও এটি শুরু হয়েছিল চতুর্দশ শতাব্দীতে এবং শেষ হয় সপ্তদশ শতাব্দীতে এসে। রেনেসাঁর আগে অন্ধকার যুগে ধর্মান্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি শোচনীয় অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল, আজকের দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মতোই। স্বাধীন ও মুক্তচিন্তা রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। অন্ধকার যুগ অবসানের জন্য রোমান সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। পণ্ডিতগণ আশ্রয় নেন ইতালিতে এবং তাদের প্রচেষ্টায় ইতালিতে শুরু হয় জাগরণ। এরপর নগররাষ্ট্রসমূহের মধ্যে এক প্রতিযোগিতা শুরু হয় ইতালি হয়ে ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, পর্তুগিজ, ইংল্যান্ড, হল্যান্ড ইত্যাদি ইউরোপীয় দেশে। রেনেসাঁ একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। ঘটে শিক্ষার পুনরুত্থান। গির্জা, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাদান শুরু হয়। মুদ্রণযন্ত্র ব্যবহার শুরু হয়। 

এতে পড়াশোনা ও বই-পুস্তক অধ্যয়নেও বিপ্লব ঘটে এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ বদলে যেতে থাকে। একারণে মানবতাবাদী বোকাচ্ছিও ও পেত্রার্কসহ শিল্পী-সাহিত্যিকদের কৃতিত্ব দেয়া হয়। রেনেসাঁ— প্রথার বিকাশ, বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণ ও যুক্তি নির্ভরতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখে।  লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মাইকেলেঞ্জেলো, কোপার্নিকাস, ব্রুনো, গ্যালিলও, নিউটন বিস্ময়কর অবদান রাখেন পরিবর্তনে। নতুন সাহিত্যের বিকাশ রেনেসাঁ তৈরিতে বিশেষ ভ‚মিকা রাখে। এতে ভূমিকা রাখেন চারণ কবিগণ। কবি দান্তে সাহিত্য রচনার নতুন ভাষা প্রতিষ্ঠা করেন। ইংল্যান্ডে চসার আধুনিক ইংরেজি ভাষার প্রকৃত রূপদান করেন। রেনেসাঁ গতি পায়। 

ইউরোপের মানবতাবাদী পণ্ডিতরা মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় লড়াই করেছেন। ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করেন— এটাকে জীবনের লক্ষ্য বিবেচনা করে। ধর্মভিত্তিক চিন্তার বাইরে তারা উদার, সহনশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ তৈরিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। প্লেটো ও হোমারের রচনা তরুণদের আন্দোলিত করে। ইতালির শতশত তরুণ প্রচলিত বিদ্যাশিক্ষা ছেড়ে দিয়ে পেত্রার্কের শিস্যত্ব গ্রহণ করেন। জ্ঞানবিজ্ঞানে যুক্তিবাদের ধারার সৃষ্টি হয়। তরুণদের মনে নতুন নতুন জিজ্ঞাসা ও অনুসন্ধিৎসা জেগে ওঠে। মধ্যযুগের শিল্পকলার বিষয় ছিল ঈশ্বর ও যিশু। কিন্তু মানবতাবাদী শিল্পীরা বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নেন মানুষকে। তারা শিল্পে মানুষের দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা ফুটিয়ে তুলেন। শিল্পী ও সাহিত্যিকরা সমাজ বদলে বিপুল ভূমিকা রাখেন। এই ধারা অব্যাহত ছিল। ভলতেয়ার, রুশোদের প্রভাবে ঘটে ফরাসী বিপ্লব। এ বিপ্লব ক্ষণস্থায়ী হলেও এর বিপুল প্রভাব পড়ে সমাজে। 


মানব ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তনের নির্ণায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। এটি সামান্তবাদের অবসান ঘটিয়ে ব্যক্তিগত মুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতি নিয়ে এসেছিল। আমাদের জন্যও সেই একই পথ। ধর্মভিত্তিক সমাজকে বিনির্মাণ করতে হবে। উদার, সহনশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ তৈরি করতে হবে। সরকারের পরিবর্তে মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে যুক্তিবাদের ধারা তৈরি করতে হবে। তরুণদের মনে জাগিয়ে তুলতে হবে নতুন জিজ্ঞাসা ও অনুসন্ধিৎসা। এসব পরিবর্তনের জন্য আমাদের কথা বলতে হবে। শত শত কণ্ঠস্বর থাকতে হবে কথা বলার জন্য। যে কথায় ইউরোপ পেরিয়ে এসেছে অন্ধকার যুগ, সে কথাই আমাদের জাগরণ ঘটাবে।

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted