ধর্মসভায় মালার অসম্মান

ধর্মসভায় মালার অসম্মান 

বর্তমানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে প্রচুর ধর্মীয় সভার আয়োজন করা হচ্ছে। বাংলাদেশে বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় বড় বড় শহরগুলোতে প্রতিনিয়ত ধর্মীয় সভা আয়োজিত হয়। সেই সভাগুলোতে প্রতিনিয়ত একটি বিষয় দেখা যায় যে, সভার কোন শ্রদ্ধেয় অতিথিকে যদি গলায় ফুলের মালা প্রদান করে  সম্মানিত করা হয়, তবে সে সেই মালা প্রদানের সাথে সাথেই সেই শ্রদ্ধেয় অতিথি তার গলা থেকে ফুলের মালাটি খুলে রাখেন। বিষয়টি যেমন দৃষ্টিকটু, তেমনি শাস্ত্রসম্মতও নয়। সনাতন শাস্ত্র অনুসারে কোন সভায় শ্রদ্ধার্ঘ হিসেবে যদি কাউকে কোন পুষ্প্যমাল্য বা ফুলের মালা প্রদান করা হয় তবে সেই মালাটি সভা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার গলায় পরিধান করে থাকা উচিত। আর যদি মালাটি গলা থেকে খুলতেই হয়, তবে তারও একটি নিয়ম আছে। মালাটি দেয়ার সাথে সাথেই হুট করে গলা থেকে খুলতে নেই।  মালাটি পাওয়ার সাথেসাথেই "খুব সুন্দর" বা "অতি সুন্দর" ইত্যাদি বাক্যে মালার দাতা ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে মালাটির প্রসংশা করতে হয়। এরপরে অত্যন্ত শ্রদ্ধায় মালাটিকে প্রণাম করে  মালার দাতা ব্যক্তিকে "অত্যন্ত কৃপা করেছেন" ইত্যাদি কৃতজ্ঞতাপূর্ণ বাক্যাদি বলে, পরবর্তীতে  সানন্দচিত্তে মালাটি গ্রহণ করতে হয়। এ বিষয়টি নিয়ে বিষ্ণু পুরাণের প্রথম অংশেই একটি অত্যন্ত সুন্দর শিক্ষামূলক কাহিনী রয়েছে। 



একবার ভগবান শ্রীশংকরের অংশে জন্মগ্রহণকারী শ্রীদুর্বাসা মুনি একান্ত মনে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। ঘুরতে ঘুরতে তিনি এক বিদ্যাধরীর (স্বর্গলোকের গায়িকা) হাতে ‘সন্তানক পুষ্পের' একটি দিব্য মালা দেখতে পান। মালাটি অত্যন্ত সুন্দর এবং সুগন্ধময়।  সে মালার সুগন্ধে সম্পূর্ণ বনাঞ্চল সুবাসিত হয়ে বনবাসীদের অত্যন্ত আনন্দ  প্রদান করছিলো। উন্মত্ত বৃত্তিসম্পন্ন বিপ্রবর শ্রীদুর্বাসা মুনি সেই সুন্দর সুগন্ধি যুক্ত  মালাটি বিদ্যাধর সুন্দরীর কাছে চাইলেন। তিনি মালাটি চাওয়ায় আয়তনেত্রী কৃশাঙ্গী বিদ্যাধরী তাঁকে সসম্মানে প্রণাম করে সানন্দে  মালাটি দিয়ে দিলেন৷ উন্মত্তবেশধারী বিপ্রবর শ্রীদুর্বাসা মুনি সেই মালাটি নিয়ে নিজ মস্তকে ধারণ করে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন৷ সে সময় তিনি দেখলেন উন্মত্ত ঐরাবতে আরোহণ করে ত্রৈলোক্যাধিপতি শচীপতি ইন্দ্র দেবতাদের সাথে নিয়ে আগমন করছেন৷ তাঁকে দেখে মুনিবর দুর্বাসা দ্রুত গতিতে ভ্রমর-গুঞ্জায়িত সেই মালা নিজ মস্তক থেকে খুলে দেবরাজ ইন্দ্রকে প্রদান করলেন। দেবরাজ সেই মালাটি নিয়ে ঐরাবতের মস্তকে পরিয়ে দিলেন। ঐরাবতের মস্তকে মালাটি পরিয়ে দেয়ায় সে মালাটি এত সুশোভিত হয়েছিল যে, দেখে মনে হচ্ছিলো  কৈলাস পর্বতের শিখরে শ্রীগঙ্গা বিরাজ  করছেন। সেই মদোন্মত্ত ঐরাবত হাতিও সেই মালার গন্ধে আকৰ্ষিত হয়ে মালাটিকে শুঁড় দিয়ে শুঁকে মাটিতে ফেলে দেয় ৷ চোখের সামনে মালাটির এমন অবমাননা দেখে মুনিশ্রেষ্ঠ দুর্বাসা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে দেবরাজ ইন্দ্ৰকে বললেন:

দুর্বাসা উবাচ
ঐশ্বর্যমদদুষ্টাত্মান্নতিস্তব্ধোঽসি বাসব।
শ্রিয়ো ধাম স্ৰজং যস্ত্বং মদ্দত্তাং নাভিনন্দসি ৷৷
প্রসাদ ইতি নোক্তং তে প্রণিপাতপুরঃসরম্।
হর্ষোৎফুল্লকপোলেন ন চাপি শিরসা ধৃতা ॥
ময়া দত্তামিমাং মালাং যস্মান্ন বহু মন্যসে।
ত্রৈলোক্যশ্রীরতো মূঢ় বিনাশমুপয়াস্যতি ৷৷ 
মাং মন্যসে ত্বং সদৃশং নূনং শক্রেতরদ্বিজৈঃ।
অতোঽবমানমস্মাসু মানিনা ভবতা কৃতম্৷৷ 
 মদ্দত্তা ভবতা যস্মাৎ ক্ষিপ্তা মালা মহীতলে।
তস্মাৎ প্রণষ্টলক্ষ্মীকং ত্রৈলোক্যং তে ভবিষ্যতি ৷৷ 
 যস্য সঞ্জাতকোপস্য ভয়মেতি চরাচরম্।
তং ত্বং মামতিগর্বেণ দেবরাজাবমন্যসে৷৷
(বিষ্ণুপুরাণ: ১.৯.১২-১৭)

"শ্রীদুর্বাসা বললেন—আরে ঐশ্বর্যের মদমত্ত-দূষিত- চিত্ত ইন্দ্ৰ ! তুমি অত্যন্ত বেয়াদপ, তুমি আমার দেওয়া অতিশয় শোভাযুক্ত মালার কোনো প্রশংসা করলে না৷

আরে, তুমি তাকে প্রণাম করে ‘অত্যন্ত কৃপা করেছেন’ তা-ও বলোনি এবং আনন্দিত হয়ে তাকে মস্তকে ধারণও করোনি৷

রে মূঢ় ! তুমি আমার দেওয়া মালার কোনো মূল্যই দাওনি, সেইজন্য তোমার ত্রিলোকের বৈভব বিনাশ হয়ে যাবে৷

হে  ইন্দ্ৰ ! তুমি নিশ্চয়ই আমাকে অন্য ব্রাহ্মণদের সমকক্ষ বলে মনে করছ, তাই তুমি অতিমানী হয়ে আমার অপমান করেছ। 

তুমি আমার প্রদত্ত মালা মাটিতে ফেলে দিয়েছ, অতএব তোমার এই ত্রিভুবন শীঘ্রই শ্রীহীন হয়ে যাবে৷

 হে দেবরাজ ! যিনি ক্রুদ্ধ হলে সমগ্র চরাচর জগৎ ভীত সন্ত্রস্ত হয় সেই আমাকেই তুমি অতি গর্বে এভাবে অপমান করেছ ৷"

অবস্থা বেগতিক দেখে দেবরাজ ইন্দ্র তখন দ্রুত ঐরাবত হাতির পিঠ থেকে নেমে নিষ্পাপ মুনিবর শ্রীদুর্বাসাকে অনুনয়- বিনয়ের মাধ্যমে প্রসন্ন করার চেষ্টা করলেন।

শ্রীপরাশর উবাচ
মহেন্দ্রো বারণস্কন্ধাদবতীর্য ত্বরান্বিতঃ ।
প্রসাদয়ামাস মুনিং দুর্বাসসমকল্মষম্৷৷ 
(বিষ্ণুপুরাণ: ১.৯.১৮)

"শ্রীপরাশর বললেন – তখন দেবরাজ ইন্দ্র শীঘ্রই ঐরাবত থেকে নেমে নিষ্পাপ মুনিবর শ্রীদুর্বাসাকে বিভিন্ন প্রকারের  অনুনয়- বিনয়ের মাধ্যমে  প্রসন্ন করলেন৷"

 দেবরাজ ইন্দ্রের প্রণামে কিছুটা সন্তুষ্ট হয়ে মুনিশ্রেষ্ঠ শ্রীদুর্বাসা  বললেন:

দুর্বাসা উবাচ
নাহং কৃপালুহৃদয়ো ন চ মাং ভজতে ক্ষমা। 
অন্যে তে মুনয়ঃ শত্রু দুর্বাসসমবেহি মাম্৷৷ গৌতমাদিভিরন্যৈস্ত্বং গর্বমারোপিতো মুধা। অক্ষান্তিসারসর্বস্বং দুর্বাসসমবেহি মাম্।।  বসিষ্ঠাদ্যৈর্দয়াসারৈঃ স্তোত্রং কুর্বদ্ভিরুচ্চকৈঃ। 
গর্বং গতোঽসি যেনৈবং মামপ্যদ্যাবমন্যসে৷৷ জ্বলজ্জটাকলাপস্য ভৃকুটীকুটিলং মুখম্। 
নিরীক্ষ্য কস্ত্রিভুবনে মম যো ন গতো ভয়ম্৷৷
নাহং ক্ষমিষ্যে বহুনা কিমুক্তেন শতক্রতো।
বিড়ম্বনামিমাং ভূয়ঃ করোষ্যনুনয়াত্মিকাম্৷৷
(বিষ্ণুপুরাণ: ১.৯.২০-২৪)

"শ্রীদুর্বাসা বললেন  হে ইন্দ্ৰ ! আমি দয়ার্দ্র চিত্তের ব্যক্তিত্ব নই, আমার চিত্তে ক্ষমার স্থান নেই। আমি অন্যান্য মুনিদের ন্যায় নই, ভিন্ন প্রকারের। তুমি জেনো রাখ যে, আমি দুর্বাসা ৷

 গৌতম প্রভৃতি অন্য মুনিগণ তোমাকে এত ওপরে তুলেছে; কিন্তু মনে রেখো আমি দুর্বাসা, ক্ষমা আমি করি না। 

দয়াশীল বশিষ্ঠ আদি মুনিগণ স্তুতি করায় তুমি এত গর্বিত হয়ে উঠেছ যে আজ তুমি আমাকেও অপমান করতে উদ্যত হয়েছো ।

 আরে, ত্রিলোকে আজ এমন কেন আছে, যে আমার প্রজ্বলিত জটাজুট ও তির্যক ভ্রূকুটি দেখে ভীত না হয় ? 

রে শতক্রতো ! তুমি বারংবার এই অনুনয়- বিনয়ের তামাসা কেন করছ? তোমার এই ক্ষমা ভিক্ষায় কী হবে ? আমি তো ক্ষমা করতে পারব না।"

এই কথা বলে সেই বিপ্রবর দুর্বাসা মুনি সেই স্থান থেকে চলে গেলেন এবং ইন্দ্রও ঐরাবতে চড়ে অমরাবতী চলে গেলেন। তখন থেকেই ইন্দ্রসহ ত্রিলোকের বৃক্ষাদি লতা ক্ষীণ হয়ে শ্রীহীন ও নষ্ট-ভ্রষ্ট হতে শুরু হল। দেবযজ্ঞাদি বন্ধ হয়ে গেল, তপস্বীগণ তপস্যা করা বন্ধ করলেন এবং লোকেদের মন থেকে দান-ধ্যান ধর্মকর্ম উঠে যেতে লাগলো। ত্রিলোকের সকল মানুষ লোভের বশীভূত হওয়ায় সামর্থ্যহীন হয়ে  যেতে লাগলো। সকলেই তুচ্ছ বস্তুর জন্য লালায়িত হয়ে ধর্মকে ভুলে যেতে লাগলো।  যেখানে সত্ত্ব বা সামর্থ্য থাকে সেখানেই লক্ষ্মীদেবী বিরাজ করেন। কারণ সত্ত্ব লক্ষ্মীদেবীরই  সঙ্গী। কিন্তু  সত্ত্বের বিহীন শ্রী বা লক্ষ্মীর স্থান কোথায় ? আবার সত্ত্ব ব্যতীত গুণ কীভাবে থাকবে ? গুণবিহীন মানুষে বল, বীর্য, শৌর্য সকল কিছুরই অভাব থাকে। তাই নির্বল ও শক্তিহীন মানুষ সকলের দ্বারাই অপমানিত হয়ে থাকে। আর অপমান প্রতিষ্ঠিত মানুষরও বুদ্ধির  বিনাশ করে।

এভাবে ত্রিলোক শ্রীহীন ও সত্ত্বরহিত হলে আসুরিক অশুভশক্তির দৈত্য- দানবেরা দেবতাদের আক্রমণ করে। সত্ত্ব ও বৈভবশূন্য শ্রীহীন দেবতাদের সাথে অশুভশক্তির দৈত্য- দানবদের ভয়ানক যুদ্ধ শুরু হয়। দেবতাদের পরাজয়ের মাধ্যমে যুদ্ধের  পরিসমাপ্তি হয়। তখন ইন্দ্রাদি সকল দেবতাগণ অগ্নিদেবকে সাথে করে মহাভাগ পিতামহ শ্রীব্রহ্মার শরণ গ্রহণ করেন। দেবতাদের কাছে সম্পূর্ণ ঘটনার বিবরণ শুনে শ্রীব্রহ্মা তাঁদের ভগবান শ্রীবিষ্ণুর শরণাপন্ন হতে বললেন।

যথাবৎ কথিতো দেবৈর্ব্রহ্মা প্রাহ ততঃ সুরান্।
পরাবরেশং শরণং ব্রজধবমসুরার্দনম্।।
উৎপত্তিস্থিতিনাশানামহেতুং হেতুমীশ্বরম্।
প্রজাপতিপতি বিষ্ণুমনন্তমপরাজিতম্৷৷ 
প্রধানপুংসোরজয়োঃ কারণং কার্যভূতয়োঃ। প্রণতার্তিহরং বিষ্ণুং স বঃ শ্ৰেয়ো বিধাস্যতি৷৷
(বিষ্ণুপুরাণ: ১.৯.৩৫-৩৭)

"দেবতাদের কাছে সম্পূর্ণ ঘটনার বিবরণ শুনে শ্রীব্রহ্মা তাঁদের বললেন, হে দেবগণ ! তোমরা দৈত্য দলন পরাবরেশ্বর ভগবান শ্রীবিষ্ণুর শরণাগত হও, যিনি জগৎ-সংসারের উৎপত্তি-স্থিতি- লয়ের কারণ, কিন্তু (বাস্তবে) কারণও নন। যিনি চরাচরের ঈশ্বর, প্রজাপতিসমূহের প্রভু, সর্বব্যাপক, অজেয়, অনন্ত এবং অজ কিন্তু কার্যরূপে পরিণত হয়ে প্রধান (মূল প্রকৃতি) ও পুরুষের কারণ এবং শরণাগত বৎসল। (তাঁর শরণাগত হলে) তিনি অবশ্যই তোমাদের মঙ্গল করবেন।"

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 
সহকারী অধ্যাপক, 
সংস্কৃত বিভাগ, 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted