বেদের মধ্যে কি বিজ্ঞান আছে?

বেদের মধ্যে কি বিজ্ঞান আছে?

এটা নিয়ে বলার আগে গ্রীক উদাহরণ না দিয়ে বুঝানো যাবে না। গ্রীকদের ধর্মটি এখন জাদুঘরে। জিউস এ্যাপোলো আজ কল্পকাহিনীতে পরিণত। গ্রীসের জিউস আর ভারতবর্ষের শিব একই রকম দেবতা। বিস্ময়কর হচ্ছে ভারতবর্ষে শিব আজো ঈশ্বর হিসেবে পুজিত হোন। যদি গ্রীক ধর্মটি টিকে থাকতো তাহলে আজো জিউস এ্যাপোলো আর কয়েক কোটি দেব-দেবীও টিকে থাকতো। সঙ্গে সঙ্গে অ্যারিস্টটল সক্রেটিস প্লুটো হতেন সেই ধর্মের “ঋষি”। তাদের বইগুলি হতো “বেদ”। এগুলো ধর্মগ্রন্থ হিসেবে মান্যতা পেতো। কারণ পুরো ইউরোপ হতো জিউস এ্যাপোলো ধর্মের অধীন। ভক্তরা প্রাচীন গ্রীক চিন্তাবিদদের তাদের ধর্মের মধ্যে গ্রন্থিত করে নিতো। কাজটা সহজও ছিলো। অ্যারিস্টটল সেসময়কার ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন। সক্রেটিস প্রচলিত ধর্মসম্পর্কে আস্থাহীন থাকলেও মনে হয় না ঈশ্বরে অবিশ্বাসী ছিলেন। ফলে তাদেরকে পরবর্তীকালের ধর্মবেত্তারা সহজেই গ্রীক ধর্মের “ঋষি” বানাতে পারতেন। 


অ্যারিস্টটলের সময় কোন যন্ত্র আবিস্কার হয়নি। ফলে তাকে পর্যবেক্ষণ ও অনুমান করে সব বলতে হয়েছে। তিনি পৃথিবীকে স্থির বলেছে। কিন্তু চাঁদের যে নিজস্ব আলো নেই সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। আজ আমরা জানি পৃথিবী স্থির নয় তবে চাঁদের সত্যি সত্যিই নিজস্ব কোন আলো নেই। বেদের ঋষিদের বক্তব্যও আপনি অনুসন্ধান করলে তেমন করেই পাবেন। হাজার বছর আগে ভারতে বসে কোন রকম যন্ত্রপাতি ছাড়াই পর্যবেক্ষণ ও অনুমানের ভিত্তিতে মহাবিশ্ব সৃষ্টি নিয়ে তখনকার ভারতীয় ‘অ্যারিস্টটলরা’ যা বলেছেন তার সঙ্গে বর্তমান মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের জানার তথ্যগত মিল আপনি সেখানে পাবেন। কারণ “বেদ” কে শুধু ধর্মগ্রন্থ মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে অনেক বড় ভূল হবে। ঋষিরা আসলে অ্যারিস্টটলের মতই ছিলেন চিন্তাবিদ, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক...।

“হিন্দু ধর্ম” নামের ধর্মটির জন্ম ভারতে মুসলমান আগমনের পর পর। বেদ হিন্দুদের “প্রধান গ্রন্থ” কি করে হলো বলা মুশকিল। “সব কিছু বেদে আছে” বা “বেদবাক্য অলংঘনীয়” এইসব দর্শন মরে যাবার যখন ধর্মের যখন জন্ম হয়েছিলো তখন ধর্মবেত্তরা সৃষ্টি করে। নইলে নাস্তিকতা নিরীশ্বরবাদী দর্শনগুলো বেদে থাকলে কি করে সেটা বর্তমান শুধু ধর্মগ্রন্থ হয়?

আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে বেদ প্রণিধান যোগ্য নয়। কিন্তু বেদ হচ্ছে ভারতবর্ষের চিন্তাশীলতার ইতিহাসের স্মরক। ভারত যখন মহাবিশ্ব সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করেছে তখন পৃথিবীর অন্য প্রান্তে লোকজন পশুর পাল নিয়ে ছালবাকল পরে ঘুরে বেরিয়েছে যাযাবরের মত। ফলে বেদের মধ্যে বিজ্ঞান খোঁজতে যাওয়া বা তাকে বিজ্ঞান বলে স্বীকৃতি দেয়াটা নিশ্চয় আহাম্মকী হবে না, তবে বেদকে গুরুত্ব দিতে হবে নিজেদের এই অঞ্চলের চিন্তাশীলতার দলিল হিসেবে। মহাভারতকে যেমন আজকের হিন্দুরা পবিত্র ধর্মগ্রন্থ মনে করে ভক্তি করে, সেটি একটি সংকীর্ণ চিন্তা হবে। মহাভারত হচ্ছে এই অঞ্চলের মহান সাহিত্যকীর্তি। 

তেমনি করে বেদের ঋষিদের বিজ্ঞান চিন্তা, ধর্মচিন্তা, মানুষের জীবন দর্শন, সমাজজীবন, সব কিছু নিয়ে গভীর আলোচনার আকর গ্রন্থ হিসেবে জানতে হবে। বেদ বাইবেল বা কুরআনের মত কোন ধর্মগ্রন্থ নয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন, হিন্দু ধর্মটা যেটাকে আমরা আজকে চিনি, সেটি আসলে কবিদের সৃষ্টি করা। কথাটা যে খুব খাঁটি সেটা গীতা পড়লে বুঝা যায়। গীতার গভীর কথাগুলো কোন ঈশ্বরের নয়। একদম মানুষের জীবনদর্শন। বুদ্ধের বাণীগুলো যেমন ঈশ্বর পরকাল নিয়ে নয়। পার্থিব জীবন থেকে নির্বাণ লাভের সন্ধান তেমনটা বাইবেল বা কুরআন বা তাওরাত নয়। বাইবেল কুরআনে পার্থিব জীবনকে তুচ্ছ করে কিভাবে অতিদ্রুত পরকালে অনন্তকালের জীবনে যেতে হবে তারই সন্ধান।

গ্রীক ধর্মের সঙ্গে আজকের কথিত হিন্দু ধর্মের দর্শনগত তফাত ছিলো বড় আকারের। ফলে গ্রীকদের ধর্মটি বিলুপ্ত হয়ে গ্রীক বিজ্ঞান আলাদা থাকতে পেরেছে। অন্য দিকে ভারতের এই হিন্দু ধর্মটি বেদের ঋষিদের চিন্তাকেও ধারণ করেছে ধর্মের আলোকে। বেদের মহাবিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কে যা বলেছে তা বিস্ময়কর কারণ তখনকার ঋষিরা মোটামুটি বিগব্যাংয়ের সময়কার কাছাকাছি ধারণা দিতে পেরেছিলেন। যেমন একজন গ্রীক দার্শনিক বলেছিলেন, মানব শিশুরা আজকে যেমন নাজুক হয়ে জন্ম নেয় তাতে মনে হয় প্রাচীন গুহামানবদের সময় এরকম শিশু জন্ম নিলে তাকে বাঁচানো কঠিন হতো...’। অর্থ্যাত তিনি ধারণা দিয়েছিলেন অতিতে মানব শিশু আজকের মত করে জন্মাতো না। এটা পরিস্কার বিবর্তন বিজ্ঞানের ধারণা। এটাই ডারউন উনিশ শতকে পূর্ণ রূপ দিয়েছিলেন। বেদের সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা গ্রীক দার্শনিকদের সেরকম অনুমাণ ও পর্যবেক্ষণমূলক মাত্র। ভারতের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান যদি বেদে সেরকম কোন জ্ঞানের ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন তাহলে সেটা বাড়াবাড়ি করে বলেননি। কিন্তু সেটা তথাকথিত ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বেদকে তুলে ধরে যদি বলেন মস্ত বড় বিপদের কথা! হিন্দু বা সনাতন সাথে অরব্য মাহাজাব গুলিয়ে ফেলেলে বড় ভূল হয়ে যাবে।

ভারতের চিন্তাশীলতায় হাজার বছরের শৃঙ্খল পরেছিলো। তাই ঋষিদের উত্তরসুরী তৈরি হয়নি। সমস্যা হচ্ছে আজকের “হিন্দু ধর্ম” নিয়ে। এখানে বহু কুসংস্কার এমন করে আজো বেঁচে আছে যে, এইসব বেদের আসল কথা বললে সেইসব কুসংস্কার আর বর্ণবাদের ধারক বাহক লোকজন মাথা নেড়ে সমর্থন জানিয়ে তাদের গলিত পঁচাগলা জাতপাত ধারণাকেই এগিয়ে নেবার সুযোগ খুঁজবে। এই কারণেই এসব নিয়ে কথা বলতে আগ্রহ কম পাই...।

©সুষুপ্ত পাঠক

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted