নারীশিক্ষাকে আপনার পরিবার 'পাপকাজ' মনে করতেন।

-আপনাকে আমি কখনোই 'মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত' বলে মনে করি না। কারণ আমি বিশ্বাস করি নারীর কোন ধর্ম নেই, দেশও নেই। আপনাকে স্বাগতম রোকেয়া। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালিদের মধ্যে আপনি একজন। আমাকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

-তোমাকেও। বলো কী জানতে চাও?

-নারীশিক্ষাকে আপনার পরিবার 'পাপকাজ' মনে করতেন। আপনার মা গোঁড়া পর্দানশিন ছিলেন। বাবাও গোঁড়া মুসলমান।

-ঠিক তাই। আর দশটি ধনী মুসলিম পরিবার যেমন ছিলো তেমন। রংপুরের 'সাবের' পরিবার সম্ভ্রান্ত মুসলিম বনেদি হিসেবে পরিচিত। যদিও আমরা বসবাস করতাম কোলকাতায়।

-আপনাকে পাঁচ বছর বয়সেই পর্দা করতে হয়েছিলো নারীদের কাছেই। বাইরে মেয়েদের সামনেই আসা যেতো না! এমনকি মেয়েদের হাতের লেখা কোন পরপুরুষের চোখে পড়লে সেটা বেপর্দা হয়ে যাবে বলে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো হতো না।...

-হুম। আমার বড় বোনকে কেবল কুরআন মুখস্থ করা শেখানো হয়েছিলো। ভাইরা যখন ফারসি শিখতো মৌলবির কাছে, বোন যাতে শুনতে পায় তাই জোরে জোরে ওরা পড়তো। এভাবে বাংলা বানান ও বর্ণ শেখাটাও ভাইদের জোরে জোরে বলা থেকে শিখেছিলেন। একদিন ঘরের মাটির মেঝেতে নিজের চেষ্টায় বাংলা লিখতে গিয়ে ধরা পড়লেন বাবার কাছে। ভাবলেন বাবা প্রচণ্ড রেগে যাবেন। কিন্তু তার বদলে তাকে কোলে করে বাবা বাংলা শেখাতে লাগলেন। কিন্তু আলেম ওলামারা এটা জানতে পেরে খুব চটে গেলেন। মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো তো শরীয়তে জায়েজ নাই। আমার বোনকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় এরপর...।

-আপনার ভাই ইব্রাহিম অরবিন্দ ঘোষের পিতা ডাক্তার কেডি ঘোষের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। প্রগতিশীলতার এই ছোঁয়া পরবর্তীতে তাকে স্যার সৈয়দ আহমদের অনুরক্ত করে তোলে। ফলে আপনার জন্য দ্বার খুলে যায়।

-একদম। আমার ভাই ও আমার বড় বোনের কথা বলতেই হবে। জানো, আমার বড় বোন ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাময়। দুঃখজনক হলো সেকালের কঠিন মুসলিম সমাজ সেই প্রতিভাকে গলাটিপে হত্যা করেছে। ১৪ বছরে তার বিয়ে হয়। তবু নিজের চেষ্টায় তিনি ইংরেজি ফারসি আরবি শিখেছিলেন। একবার কী হয়েছিলো, আমি আর আমার বোন প্লানচেটে বসে আত্মা নামাতে লাগলাম। আমি আমার আয়ার আত্মা নামালাম। সে আত্মা যখন ইংরেজিতে বাক্য লেখা শুরু করলো, তখন বোন বলে উঠলো, আরে মরার পর আয়া দেখি ইংরেজি শিখে গেছে- আহা ইংরেজি শেখার জন্য তাহলে আমাকে দেখি মরতে হবে!... কতখানি শিক্ষানুরাগী ছিলেন তিনি এই ঘটনা থেকে বুঝতে পারো।

-আপনাকে এখন 'প্রকৃত নারীবাদী' বা 'ভদ্র নারীবাদী' বলা হয়!

-বটে! তাহলে শোনো, সেকালে আমার লেখাকে কী রকম উগ্র আর বিদ্বেষী বলা হতো! দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, মানে সেই 'ঠাকুরমার ঝুলি' সংগ্রাহক মহাশয় বলেছেন- সমাজ সংস্কার করা এক কথা, আর তাকে বেদম চাবুক মারা আরেক কথা। চাবুকের চোটে সমাজদেহের ক্ষত হইতে পারে তাতে সমাজের কোন ক্ষতি বা উপকার কোনটাই হয় না। 'মতিচূর' রচয়িত্রী সমাজকে কেবল চাবুক চাবকাইতেছেন...। তিনি যদি বিদ্বেষহীন ভাষায় নারী জাতির সমস্যা বিবৃত করেন তাহা হইলে সমাজের উপকার হইবে...।... হাঃ হাঃ হাঃ কী বুঝলে? এখন তোমাদের লেখা পড়েও কিন্তু কেউ কেউ এরকম প্রেসক্রিপশন দেয়, তাই না?

-আপনি নাস্তিক ছিলেন না। চিঠিপত্রে আপনার আল্লাহ বিশ্বাস প্রকাশ পেতো। অথচ আপনাকে ইসলামের শরীয়তের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছিলো সারাজীবন। যদি বলি, আপনি হয়তো ধর্মবিশ্বাসকে আপনার মতো করে নিয়েছিলেন?

-আমি প্রকৃতির দিকে চেয়ে দেখেছিলাম সেখানে একটা নিয়ম খাটে যা সমাজের ধর্মের নিয়মের বিপরীত। প্রকৃতির নিয়ম বৈষম্যহীন। তাই লিখেছিলাম- প্রকৃতি নারী পুরুষকে সমান চোখে দেখে। ছেলেদের জন্য দশমাস গর্ভ বা মেয়েদের জন্য পাঁচ মাস তা নয়, মাতৃদুগ্ধ মেয়েরা কম পায় ছেলেরা বেশি পায় সেরকম তো ঘটতে দেখি না। তাহলে নারী পুরুষের অধিকারে কেন বৈষম্য? এর মানে, এগুলো আমরা বানিয়েছি!

-প্রায় একশো বছর আগে লিখে গেছেন, নারীদের জন্ম কেবল শাড়ি গয়নাগাটি পরার জন্য নয়, পতিদেবতার মনোরঞ্জন করার জন্য নয়। নারীরা যেন অন্নবস্ত্রের জন্য অন্যের গলগ্রহ না হয়।... শারীরিক শিক্ষা হিসেবে লাঠি ও ছোরা চালানো শেখার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

-এজন্য আমাকে কোলকাতা শহরে রূপ-যৌবনের দোকান খোলার অভিযোগ করা হয়েছিলো জানো!

-আচ্ছা, মুসলমানদের শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে থাকার জন্য আমাদের প্রচলিত ইতিহাস হিন্দুদের দায়ী করে। মুসলমানরা এ কারণেই লাহোর প্রস্তাব তুলেছিলো আপনার মৃত্যুর আট বছর পর। তারা বলেছিলো মুসলমানদের নিজস্ব দেশ না হলে হিন্দুদের কারণে তারা শিক্ষাদীক্ষা অর্থনীতিতে পিছিয়ে থাকবে।

-তাই? তাহলে শোনো, আমার বোন বিয়ের নয় বছরের মধ্যে বিধবা হন। তার দুই ছেলের শিক্ষার জন্য তিনি কী করেছিলেন শোনো। বড়টিকে বিলেত পাঠান। আর ছোটটিকে কোলকাতার সেন্ট জেভিয়ারে ভর্তি করেন। এটা করায় তাকে যে গঞ্জনা, গালমন্দ, সমাজের কাছে যে কটূক্তি, অপমান, একঘরে অবস্থায় থাকতে হয়েছে তার জবাব কী হবে? ভালো শিক্ষায় কি হিন্দুরা বাধা দিয়েছিলো নাকি দিলো নিজ কমিউনিটির লোকজন? এই যে আমাদের রংপুরের 'সাবের পরিবার', কোলকাতায় কি আমাদের অবস্থা খারাপ ছিলো? মর্যাদায়? তাহলে কেন পাকিস্তানের প্রয়োজন হলো? কারণ কিছু লোকের রাজা হতে হলে এটা দরকার ছিলো। তুমিই বলো, পাকিস্তান হবার পর কি মেয়েদের আলাদা করে কোন মুক্তি মিলেছিলো? আমার স্বামী সাখাওয়াতের কথাই ধরো। গরীব ঘরের ছেলে। নিজের যোগ্যতায় লেখাপড়া শিখে বিলেত থেকে ডিগ্রী নিয়ে ফিরে ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছিলেন। কই অখণ্ড ভারতবর্ষ তার শিক্ষা ও উন্নতিতে তো বাধা হয়নি।

-আপনার জীবনে আপনার স্বামীর ভূমিকা...

-তিনি না হলে রোকেয়ার বিকাশ হতো না। রোকেয়াকে জন্ম দিয়েছিলেন আসলে আমার ভাই ও বোন। কিন্তু বিকাশ হয়েছিলো সাখওয়াতের কাছে।

-রোকেয়া, আপনার কাছে আমার একটি প্রশ্ন- আপনার কাজের ফলে বাঙালি মুসলমান নারীদের মুক্তি মিলেছিলো, তার জন্য মুসলমানদের নিজস্ব দেশ পাকিস্তান সৃষ্টি করতে হয়নি। উল্টো পাকিস্তান হবার পর মুসলমান নারীদের পায়ে শিকল পরানোর নানা রকম আইন তৈরি হয়েছিলো ইসলামী জোশে। তাহলে আমাদের ইতিহাস ও রাজনীতি যেভাবে মুসলমানদের কল্যাণের কথা বলে তা কেবল পুরুষদের বোঝায়? নারীর আসলে কোন দেশ নেই? মুসলমানদের নিজেদের দেশ হলেই বা সেখানে নারীদের কী লাভ?

-তোমাকে তাহলে আমার মামী শাশুড়ীর একটা কাহিনী বলি। তিনি ভাগলপুর থেকে পাটনা যাচ্ছিলেন। তার সঙ্গে তার একমাত্র পরিচারিকা। কিউল স্টেশনে ট্রেন বদল করার সময় মামীমা তার বিশাল বোরখায় জড়িয়ে ট্রেন ও প্লাটফর্মের মাঝখানে পড়ে যান। লোকজন কুলি সকলে মামীমাকে ওঠাতে ছুটে আসতেই মামীমার পরিচারিকা সকলকে সাবধান করে দেন মুসলিম জেনানার গায়ে হাত দেয়ার কেউ যেন চেষ্টাও না করে! সেই পরিচারিকা নিজে বহু চেষ্টা করেও বোরখায় জড়ানো মামীমাকে উদ্ধার করতে পারলো না। আধঘণ্টা পর ট্রেন ছেড়ে দিলো মামীমাকে সঙ্গে করে। হাড্ডি-মাংস চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে একতাল মাংসের মতো মামীমার নিথর দেহ পড়ে রইলো স্টেশনে... সেই পরিচারিকা তখন সেই মাংসপিণ্ডের সামনে বসে বাতাস করছিলো আর বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছিলো। শত শত মানুষ চোখের সামনে এই দুর্ঘটনা (না আত্মহত্যা?) চেয়ে চেয়ে দেখলো কিন্তু কারোর অনুমতি মিললো না তাকে উদ্ধার করার! কারণ মুসলিম জেনানার গায়ে হাত দেয়ার ফল কী হতে পারে ভেবে সবাই শংকিত ছিলো। সুষুপ্ত, এই নির্মম ঘটনায় কী দেখতে পাও বলো তো? একটা হচ্ছে মুসলিম সমাজের পর্দা প্রথাটা কতখানি অমানবিক ও মানসিক বিকারগ্রস্ততা পেয়েছিলো। দুই, অবিভক্ত ভারতে মুসলিমদের সামাজিক অবস্থানটাও পরিষ্কার। প্লাটফর্মে স্বাভাবিকভাবেই হিন্দুই তো ছিলো সবাই। সেখানে একটি মুসলিম পর্দানশিন নারী তার পর্দার প্রতি জেদ, সকলকে হুঁশিয়ার করে দেয়ার হিম্মত দেখিয়েছিলেন। ফলে আলাদা করে অধিকার বানাবার 'পাকিস্তান' সৃষ্টির কোন দরকার ছিলো কি? ভারতে মুসলমানদের অভাবটা কী ছিলো বলো তো আমায়? বরং আমার কপাল ভালো যে আমি পাকিস্তানে জন্ম নিইনি! আমি অবিভক্ত ভারতের ইংরেজ শাসিত কোলকাতাকে পেয়েছিলাম। না হলে আমি কী করে মুসলমান নারীদের শিক্ষা দেবার কথা এত জোরেশোরে বলতে পারতাম বলো?

-আপনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, নারীদের দুঃখ দুর্দশা দেখে ঈশ্বর কি শুনিতে পান না? তিনি কেমন দয়াময়?

-হ্যাঁ, বিহারের মুসলমান মেয়েদের ও হিন্দু মেয়েদের দুর্দশা দেখে আমি সেকথা বলে উঠেছিলাম।

-আঠারো বছর বয়সে আপনার বিয়ে হয়েছিলো। এটা খুবই ইন্টারেস্টিং! সেকালে দশ-বারো বছরে যেখানে মেয়েদের বিয়ে দেয়া হয়...

-এটা সম্ভব হয়েছিলো আমার দুই ভাইয়ের কারণে। আমাদের গোঁড়া মুসলিম পরিবারে কেবল পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত দুটি ভাই সমস্ত কুসংস্কার ভেঙে প্রগতির প্রবেশ করিয়েছিলো। ফলে আমার বাল্য বিয়েটি হয়নি। আমার যখন বিয়ের কথা চলছিলো তখন আমার ভাই ইব্রাহিম সাবের চিন্তিত ছিলেন তার বোনকে তিনি কোথায় পাত্রস্থ করবেন। যেভাবে তিনি আমাকে গড়ে তুলেছিলেন আমাকে তো সেরকমই একটি জায়গায় রাখতে হবে। না হলে তো অবধারিতভাবে সেটি হবে সাংঘর্ষিক। সেরকমই একজন আধুনিক মানুষকে পাওয়া গেলো। অবাঙালি বিহারি একটি মানুষ, আমার স্বামী সাখওয়াত। আঠারোতে বিয়ে হয়ে আটাশ বছর বয়সে বিধবা হই। মাত্র দশ বছরের দাম্পত্য জীবন। কিন্তু তার ঋণ আমি কী করে ভুলি বলো? মানুষটি আমাকে নারী জাগরণের পথ দেখিয়ে সেখানে ঠেলে দিয়ে চলে গেলেন। ডায়াবেটিস রোগে তিনি তখন মরতে বসেছেন। বুঝতে পারছিলেন তার সময় ঘনিয়ে এসেছে। মৃত্যুর আগে ডায়াবেটিসের কারণে চোখ হারালেন। মিতব্যয়ী সাখাওয়াতের সঞ্চয় তখন সত্তর হাজার টাকা! সেকালে এটি বিপুল অর্থ। তিনি তার থেকে দশ হাজার টাকা আমাকে দিয়ে বললেন, তুমি একটি বালিকা স্কুল তৈরি করে নারীশিক্ষার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করো। তিনি বুঝতে পারছিলেন, যেহেতু আমাদের কোন সন্তান নেই তাই সে যখন থাকবে না তখন আমি কী নিয়ে বেঁচে থাকবো। তাই তিনি এমন একটি মহৎ রাস্তা খুঁজে বের করলেন, যে রাস্তায় কাজ করতে আমি এতদিন ধরে তৈরি হচ্ছিলাম। কেবল জানতাম না কীভাবে শুরু করবো। সেই রাস্তাটাই তিনি আমাকে দিয়ে গেলেন। তার মৃত্যুর পর আমি নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা পাই। স্বামীর মৃত্যুর মাত্র পাঁচ মাস পরে পাঁচটি ছাত্রী নিয়ে শুরু করি সাখওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। কিন্তু সেখানে টিকতে পারলাম না আমার স্বামীর প্রথম পক্ষের মেয়ে ও তার জামাইয়ের কারণে। টাকাপয়সা সম্পত্তি বড় খারাপ জিনিস সুষুপ্ত! শেষে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে ভাগলপুর থেকে চিরকালের জন্য কোলকাতা চলে এলাম। সঙ্গে সঙ্গে সাখওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলও চলে এলো কোলকাতায়...

-আজকের যুগের মেয়েরা জানে না আপনি কী উপায়ে সেদিন লড়াই করেছিলেন। স্কুলের মোটরবাসের কথাটা...

-সে এক কাণ্ড! কীসের সঙ্গে আমাকে লড়তে হয়েছিলো শোনো। একদিন আমার এক ছাত্রী হীরার বাবা পত্র লিখে জানালেন, আমাদের মোটরবাস তাদের গলির ভেতর যায় না ফলে হীরাকে চাকরানির সঙ্গে অনেকখানি হেঁটে বাড়ি যেতে হয়। সেদিন যেতে গিয়ে এক লোকের সঙ্গে ধাক্কা খায় হীরা। লোকটির হাতের চায়ের কাপ থেকে হীরার গায়ে গিয়ে চা পড়ে...। তো আমি একজন শিক্ষয়িত্রীকে ঘটনা তদন্ত করতে পাঠালাম। সে ফিরে এসে উর্দুতে যা বললো তার বাংলা অনুবাদ হচ্ছে, হীরা যে বোরখা পরে আসে তাতে দেখার মতো কোন খোপ নেই। মানে চোখের জায়গায় কোন ছিদ্র নেই যা দিয়ে দেখবে। ফলে হীরাকে চাকরানি অন্ধের মতো করে গলি দিয়ে নিয়ে যায়। সেকারণেই না দেখতে পেয়ে একজনের গায়ে সে ধাক্কা খায়। একদিন একটা বিড়ালের গায়ে পা দিয়েছিলো...। মাত্র নয় বছরের একটি মেয়েকে কীভাবে ঘরের বাইরে বের হতে হতো দেখেছো? এসব কাদের জন্য করতে হয়েছিলো? হিন্দুদের জন্য? তাহলে মুসলমান সমাজের পিছিয়ে পড়ার জন্য কারা দায়ী? যাই হোক, আমাদের মোটরগাড়ীর কথা শুনবে না? বিশেষভাবে পর্দা রক্ষার জন্য এই গাড়িটি বানাতে হয়েছিলো। অন্ধকার একটি কামড়া। পেছনে এক ইঞ্চি বাই দেড় ফুটের একটি নেটের আবরণ, এটা রাখা হয়েছে শ্বাস যাতে নিতে পারে। এই অন্ধকার কামড়ায় গরমে টিকতে না পেরে কয়েকজন ছাত্রী বমি করে দেয়। ছোট মেয়েরা ভয়ে কাঁদতে থাকে। স্কুলে আসার পর দেখা যায় কয়েকজন অজ্ঞান হয়ে গেছে। মেমসাহেব শিক্ষিকা বাসের এরকম অবস্থা দেখে করলেন কী, নেটগুলো কেটে দিয়ে আলগা পাতলা কাপড় দিয়ে দিলেন পর্দার মতো যাতে একটু আলো ঢোকে। তো আমার বান্ধবী মিসেস মুখার্জী একদিন বললেন, তোমাদের স্কুলবাস দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম কোন আলমারি যাচ্ছে কিনা! চারদিকে বন্ধ তাই প্রথমে আলমারি মনে করেছিলাম। আমার ভাইপো এসে সেদিন বললো, পিসিমা, দেখবে এসো, Moving Black Hole! মানে চলন্ত অন্ধকূপ! এ থেকে বোঝা যায় বাঙালি হিন্দু কতখানি অগ্রসর হয়ে গিয়েছিলো ততদিনে। কারণ সেখানে যে বিদ্যাসাগর জন্মে গিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম নারীশিক্ষার জন্য স্কুল খুলেছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য বিদ্যাসাগর মুসলিম সমাজ নিয়ে কাজ করলে তার কল্লা থাকতো না। না হলে আরো এক শতাব্দী আগে আমাদের সমাজ এগিয়ে যেতো।

-কিন্তু মুসলিম লীগ ও বামপন্থীরা যে বিদ্যাসাগরকে দায়ী করে, তিনি কেবল হিন্দুদের জন্য কাজ করেছেন মুসলমানদের উন্নতি চাননি!

-তাই নাকি? বিদ্যাসাগরের ধড়ে মাথা তো একটিই তাই না? বামুনের ছেলে হয়ে তিনি মুসলমান মেয়েদের ঘরের বাইরে এনে লেখাপড়া করতে চেষ্টা করবেন? মুসলমানদের মধ্যে নেতা ছিলো না? অর্থে বিত্তে ক্ষমতায় তারা কম ছিলেন? তোমাকে তাহলে বলি কতখানি গুণ্ডামী আমার সঙ্গে করা হয়েছিলো। সেই যে নেট কাটা হয়েছিলো বাসের, তার ফলে আমি পাঁচটি চিঠি পেয়েছিলাম। 'Brother-in-Islam' নামে স্বাক্ষর করা চিঠিতে আমাকে বলা হয়েছিলো, যদি এরকম 'বেপর্দা বাস' আমি চালু রাখি তাহলে কয়েকটা কাগজের নাম করে বলা হলো সেখানে আমার স্কুলের নিন্দা জানিয়ে নিউজ করে দেয়া হবে! তোমাদের জানিয়ে রাখি, নারীশিক্ষা ও তাদের জাগরণের জন্য আমার বিরুদ্ধে এ কথা ছড়ানো হয়েছিলো- তিরিশ বছরের একজন বিধবা তার রূপ-যৌবনের দোকান খোলার চেষ্টা করছে। মানে আমাকে ঠিক কীসের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে বুঝতে পারছো তো? কারণ আমার স্কুলে মেয়েদের শরীর চর্চা করানো হতো, গান শেখানো হতো...।

-আপনাকে এখন 'ভদ্র নারীবাদের উদাহরণ' হিসেবে প্রগতিশীল মুসলিম লীগাররা ব্যবহার করে। বলা হয় ফুলহাতা ব্লাউজ পরা রোকেয়া থেকে আজকালকার নারীবাদীদের শেখা উচিত।

-ওমা তাই বলে নাকি? তাহলে তোমাকে বলি আমার আসল অবস্থা কী ছিলো। আমাকে আমার যুগের সঙ্গে কৌশল করতে হয়েছিলো। সেকালে যারা মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর মতো উদার ছিলেন তারাও ইসলামের কঠোর পর্দা প্রথার পক্ষে ছিলেন। ফলে আমাকে স্কুল কমিটির মিটিংয়ে পর্দার আড়ালে বসে কমিটির পুরুষ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে হতো! আমি যদি এটি না করে বিদ্রোহ করে তাদের সামনে আসতে চাইতাম তাহলে আমার স্কুল আর হতে পারতো না। একদিন কী হয়েছে বলি, মিটিংয়ের জরুরী একটি ফাইল নিয়ে কথা হচ্ছিলো। ফাইলটি ছিলো আলমারিতে। কমিটির সদস্যরা সবাই পুরুষ। ফলে আমি যথারীতি পর্দার আড়াল থেকে কথা বলছি। কেবল একজন হিন্দু শিক্ষয়িত্রী ছিলেন সেখানে যে আমার নির্দেশে সেখানে কাগজপত্র দিচ্ছিলো। এবারো দেখো তখন হিন্দুরা কতখানি এগিয়ে গিয়েছিলো। যাই হোক, আমি পর্দার আড়াল থেকে বলছি আলমারির অমুক জায়গায় ফাইলটি, সেটি আর খুঁজে পায় না। এভাবে একঘণ্টা চলে গেলো। কেউ আর খুঁজে পেলো না। তবু আমি পর্দা ভেঙে সেখানে আসতে পারলাম না! কতখানি কম্প্রোমাইজ করতে হয়েছে চিন্তা করো। আজ আমার সাজপোশাক নিয়ে যারা ইস্যু তৈরি করে তারা সেকালের সেই পর্দাপন্থীদের উত্তরসূরী জেনে রাখবে। এরাই সমাজ প্রগতির শত্রু!

-অবিভক্ত বাংলায় বা অবিভক্ত ভারতবর্ষে মুসলিম নারীদের ভবিষ্যত দেখতে পেতেন কি? আমি আসলে এটা জানতে চাইছি, আপনি পাকিস্তান আন্দোলন বা দ্বিজাতিতত্ত্ব নিয়ে কী ভাবতেন? আপনি ১৯১৬ সালে নারী অধিকার নিয়ে একটি সমিতি গঠন করেন তার নাম 'আঞ্জুমনে খাওয়াতিনে ইসলাম'। অবশ্য গোখলে মেমোরিয়াল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মিসেস পিকে রায় আপনার সম্পর্কে বলেছিলেন, রোকেয়া হিন্দু মুসলমান ভেদাভেদ মানতেন না। এটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট।

-দেখো, এটা মনে রাখতে হবে আমি মুসলিম নারীদের জাগরণে কাজ করেছি। তোমাদের মনে রাখতে হবে আমি কোন সময়ের মানুষ। সেকালের সেই রাজনৈতিক সময়ের কালে 'মুসলিম' পরিচয়টি প্রাসঙ্গিক ছিলো। না হলে আমি কী করে মুসলিম নারীদের জাগরণের কথা ভাবতাম। কারণ হিন্দু নারীদের দেখে স্পষ্ট হতো মুসলিম নারীদের অবস্থা কতটা নাজুক। আমার সমিতিও কেবল মুসলিম নারীদের সাহায্য করার জন্য গঠিত। সেজন্য নামটিও সেরকম। যদি পাকিস্তানের যৌক্তিকতা ছিলো কিনা জানতে চাও তাহলে আমার সময়কার পশ্চিমবঙ্গের তথ্য দিই। আমার সমসাময়িক, আমাকে কাছ থেকে দেখেছে আমার জীবনীকার শামসুন নাহার। তার 'রোকেয়া জীবনী' বইতে আমার সময়ের মুসলিম নারীদের যে তথ্য দিয়েছেন- 'বিমান চালনা কোর্সের জন্য দাস-রায় মেমোরিয়াল যে বৃত্তি ঘোষণা করেছিলো সেখানে মুসলিম মেয়েরাও প্রার্থী হয়েছিলো। ততদিনে প্রচুর মেয়েদের স্কুল খোলা হয়েছিলো যার পেছনে ছিলো মুসলিম মেয়েরাই। কোলকাতা হাইকোর্টের এডভোকেট হয়েছিলো মুসলিম মেয়েরা। এমনকি কোলকাতা পৌরসভার কমিশনার পর্যন্ত হয়েছিলো মুসলিম মেয়ে। সরকারী তথ্যমতে, প্রাইমারী শিক্ষায় তখন মুসলিম বালিকারা হিন্দু বালিকাদের চেয়ে এগিয়ে ছিলো।' এগুলো সম্ভব হয়েছিলো কেমন করে? আকাশ থেকে পড়েছিলো? নাকি সেই যে একদিন পাঁচজন মেয়ে নিয়ে স্কুল শুরু করেছিলাম মুসলিম পুরুষদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তার ফলে? আমার জীবনের শেষ সময়ে এসে এই যে মুসলিম নারীদের অগ্রযাত্রা আমি কোলকাতায় দেখেছিলাম, তার জন্য তো পাকিস্তানের প্রয়োজন পড়েনি? কিন্তু রাজনীতি অন্য জিনিস। এসব আমাকে জিজ্ঞেস করো না।

-কিন্তু আপনাকে স্রেফ একজন 'মুসলিম নারী' বানানো হয়েছে বাংলাদেশে। এমনকি মুসলিম আইডেন্টি দিয়ে প্রায় বাংলাদেশী বানিয়ে ফেলা হয়েছে! এখনকার কেউ ভাবতেই পারবে না আপনার সমস্ত কর্ম জীবন সবই কোলকাতায়! আপনার মৃত্যুদিনে হিন্দু মুসলমান নারী পুরুষ সকলের ঢল নেমেছিলো সাখওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের সামনে। কোলকাতার আনন্দবাজারসহ বড় বড় সব কাগজেই হেডলাইন ছিলেন আপনি। আপনার জন্য বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিলো কাগজগুলোতে। গভর্ণর জেনারেল আপনার জন্য শোকবার্তা জানিয়েছিলেন।... বাংলাদেশের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক শৈশবের পায়রাবন্দের ঐ কয়েকটি বছর মাত্র। এতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু আপনাকে নারী জাগরণের জন্য নয়, 'ভদ্র মুসলিম নারী' বানানোর জন্য উদাহরণ করা হয়েছে।

-কী করবে বলো। নজরুল ইসলামকেও তাই করা হয়েছে। শুনেছি এখন বাংলাদেশে বোরখা হিজাব ছাড়া কাউকে চলতে দেখা যায় না? আমাদের সেই 'মোটরবাস' ফেরত আসবে নাকি?

-আপনার রচনা পাঠ না করে 'রোকেয়া দিবস' আসলে সেই বাসের ফেরত আসাটা কেবল এগিয়েই আনবে...।

-আমি কিন্তু জীবনে খুব আশাবাদী ছিলাম। কখনো নিরাশ হতাম না। কাজেই আমি বিশ্বাস করি এই অন্ধকার কেটে ভোর আসবেই...।

-আপনাকে অশেষ কৃতজ্ঞতা আমাকে সময় দেয়ার জন্য।

-তোমাকেও ধন্যবাদ, সুষুপ্ত।

[তথ্যসূত্র: বেগম রোকেয়া রচনাবলী, বাংলা একাডেমি, ১৯৮৪/ রোকেয়া জীবনী, শামসুন নাহার/বেগম রোকেয়া সাখওয়াত হোসেন: চিন্তা চেতনার ধারা ও সমাজকর্ম, বাংলা একাডেমি, ১৯৯২/বেগম রোকেয়া, আবদুল মান্নান সৈয়দ]

©সুষুপ্ত পাঠক

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted