ছোটবেলায় ধারণা ছিলো যারা গান বাজনা করে, অভিনয়, ছবি আঁকে তারা মনে হয় ধর্মকর্ম করে না, তেমন ভক্তিটক্তি নেই। কিংবা ধর্ম পালন করে না...।
আর লেখক মাত্রই যে নাস্তিক সে বিষয়ে কোন সন্দেহ ছিলো না। কারণ আমার পড়া বইয়ের ৯৫ ভাগই পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের। তাঁরা হয় নাস্তিক নয়তো প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাস রাখে না। শীর্ষেন্দুর মতো ব্যতিক্রম নিশ্চয় আছে।
পরে দেখলাম, ঢাকার বেইলি রোডে নাটক পাড়ার লোকজন 'আল্লার রহমত' 'ইনশাল্লাহ' 'সোবাহানাল্লা' বলে! নামাজ রোজাও করে! ঢাকার লেখকদের বেশির ভাগই খাজা নাজিমুদ্দিনের ডুপলিকেট! এরা সরাব খায়, পতিতাদের সঙ্গে ঘোরে কিন্তু জিন্নার মতোই মুসলমান!
নাটকপাড়ার একজন আমাকে বলেছিলো, আশ্চর্য, নাটক করি বলে ধর্মকর্ম করবো না? কেন ভারতের হিন্দুরা কি অভিনয় করে বলে ধর্ম পালন করে না... অমুক তমুক অনেকের উদাহরণ দিলো।
আমি বলেছিলাম, আমার খটকা অন্য জায়গায়। নাচের শিল্পী যদি প্রবলভাবে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী হয় তবে তার নাচ নিয়ে তো সাংঘর্ষিক অবস্থান তৈরী হবে ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে। কিন্তু ভরতনাট্যম নাচটা হিন্দুরা বিশ্বাস করে এটি ঋষি ভরত স্বর্গ থেকে শিখে এসেছিলেন। আর বড় বনেদি হিন্দুবাড়িতে 'নাটমন্দির' থাকতো। সেখানে দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে ভক্তিমূলক নৃত্য-গীতি পরিবেশন হতো। সরস্বতীর হাতে বীণা নামের একটা বাদ্যযন্ত্র আছে। তো কোন মিউজিশানের সঙ্গে হিন্দু ধর্মের তো কোন সংঘর্ষ নেই। কিন্তু মুসলিম ধর্ম বিশ্বাসের কোন সোর্স থেকেই গান, বাদ্য, অভিনয়, নাচ, ভাস্কর্য, পেন্টিং- কোন কিছুর অনুমোদন নেই।
এখন পরিস্থিতি আরো ভয়ংকর। এখন নাটক সিনেমা দখল হয়ে আছে ফারুকীদের মতো মুসলিম লীগারদের হাতে। লেখালেখি ঝাকির-সলিমুল্লাদের মতো মুসলিম লীগারদের হাতে। গোটা পৃথিবীতে মুসলিম শিল্পীদের কমন সমস্যা একটি। তাদের শিল্প ও তাদের ধর্মকে ব্যালেন্স করতে গিয়ে তারা এক পর্যায়ে মৌলবাদী হয়ে যান। কেউ নিজের মতো করে একটা ইসলাম বানান যার সঙ্গে মূল ইসলামের কোন যোগ নেই। তারা গোঁয়ারের মতো ইসলামকে ডিফেন্ড করে চলেন। এরাই মডারেট মুসলমান। এরাই বিপদজনক। 'রেডিও আরজে' এমন লোকজন যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে ছেলেমেয়েদের মেলামেশা করার ক্ষতিকারক দিক তুলে ধরা কাউকে সমর্থন করে সেটা যে এতদিন ধরে তার আরজে পেশার উল্টো একশো আশি ডিগ্রী অবস্থান, এটা বোঝার মতো বোধও নেই! নাটকে বেগানা নারীদের সঙ্গে নাচাগানা করে কেউ যখন নারীদের ঘরের ভেতর থাকার পরামর্শকে পিঠ চাপড়ে সাপোর্ট করে তখন সে যে তার পেশার সঙ্গে বিরোধীতা করছে, তার নারী সহঅভিনেত্রীদের অবস্থানের বিরোধীতা করছে সেই বোধও তাদের নেই।
এদের যুক্তিবোধও কোন্ লেবেলের, উদাহরণ দিই।
একবার সিনেমা দেখে বের হয়ে বলেছিলাম, সিনেমা শুরুর আগে এই যে বিসমিল্লাহ রাহমানির রাহিম লেখা দেখায় এর কোন অর্থ হয়? ইসলামে সিনেমা জায়েজ আছে?
সঙ্গের ছেলেটি ফট করে যুক্তি দেখায়, ভারতের সিনেমা শুরুর আগে যে দেবদেবীদের ছবি দেখায় তখন? হাসলাম। বাংলাদেশের সিনেমার কথা হচ্ছে আর দৌড়ে সে ভারতে চলে গেছে! যাই হোক, তাকে প্যাঁচে ফেলতে বললাম, হিন্দু ধর্মের কোথাও অভিনয় নাচ এইসব নিষিদ্ধ নয়। মন্দিরে এসব আয়োজন করতেই নাটমন্দির বানানো হতো। ইন্দ্রের প্রাসাদে রোজ নৃত্য করে উর্বশিরা। ফলে হিন্দি সিনেমার শুরুতে মারোয়ারি প্রডিউসার যদি তাদের গণেশকে ধুপধুনো নাচিয়ে মনে মনে ভালো ব্যবসার আশা করে তো অন্তত তাদের ধর্মের সঙ্গে সেটা সাংঘর্ষিক হয় না। কিন্তু বিসমিল্লাহ বলে নাচাগানা শুরু করলে খুবই হাস্যকর হয়ে উঠে! যেমন টেলিভিশনে আজান দেয়া! কুরআন তেলাওয়াত দিয়ে সূচনা করা!...
ছেলে একদম চুপ!
কয়েকদিন আগে আরেক ঘটনা। বলছিলাম ইসলামে গান বাদ্য নিষিদ্ধ করে কতবড় ভুল করা হয়েছে...। ফট করে একজন বললো, জানেন ভারতের শাস্ত্রীয় সংগীতের বড় বড় নাম সব মুসলমানদের?
এই হচ্ছে এক যন্ত্রণা! যুক্তির একটা লেবেল থাকতে হবে তো! ভারতের সংগীতের মুসলিম নামের শিল্পীদের বিরাট একটা উপস্থিতি আছে বলেই কি সেটা ইসলামে জায়েজ প্রমাণ হয়? সুলতানা রাজিয়া তার বাবার সাম্রাজ্য চালিয়েছিলো বলেই কি ইসলামে নারী নেতৃত্ব জায়েজ হয়ে যায়? সামান্য যুক্তিবোধও এদের এত দুর্বল!
©সুষুপ্ত পাঠক
Post a Comment
যুক্তি সংগত কথা বলুন.................