ইজরায়েল যেভাবেই গঠিত হোক, এটা বাস্তবতা। তাকে মেনে নিয়েই ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা।

ফিলিস্তিন কিংবা আফগান বিষয়ে আমরা কি জেনে-বুঝেই জিহাদী-মুজাহিদদের সমর্থন করে যাচ্ছি? যখন আমাদের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীরা বলতে চান, আরবরা যেহেতু এখনো গণতন্ত্র বুঝে না তাই তাদের মুক্তিযুদ্ধের বর্হিপ্রকাশটা বাইরে থেকে দেখে ইসলামিক মনে হয়…। আরব তথা মধ্যপাচ্যে বিদেশী শক্তির আক্রমন, শাসনের চেষ্টা ছিল ও আছে। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের লড়াইও চলছে। কিন্তু সেটা কিছুতে দেশপ্রেমের চেতনায় জাতীয়তাবাদী মুক্তি সংগ্রাম বলা যাবে কি? 

আফগানিস্থান ও ফিলিস্তিনে জিহাদ করা শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম বলেন, “আমরা কি আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু প্রাণকে কি সামান্য ভূখন্ডের জন্য উৎসর্গ করব? ফিলিস্তিনের মাটি আর ফুজাইরার মাটির মুল্য তো একই। ঘর তো আমার যেখানে ইচ্ছা সেখানে নির্মাণ করা সম্ভব। ব্যাপার তো জমি আর মাটির নয়। ব্যাপার হচ্ছে দ্বীনের, আকীদার, পবিত্র ভূমির, মসজিদুল আকসার ও সে সব লোকদের, যারা হুর ও জান্নাত লাভের প্রতিযোগীতায় নেমেছে। যদি জান্নাত ও হুর না পাই, তাহলে কেন আমি নিজের প্রাণ উৎসর্গ করব?”।

ইহুদীদের জেরুজালেম মুসলিমদের মক্কা-মদিনার মতই পবিত্র ভূমি।  বাইতুল মোকাদ্দেস বা সোলেমানের মন্দির দখল করার অভিলাষ কি করে পরাধীনতা থেকে মুক্তি পেতে দেশপ্রেমি মুক্তিযুদ্ধ হয়? যারা হুর ও জান্নাত লাভের প্রতিযোগিতা করছে তারা জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেম যে ফলাচ্ছে না সেটা শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম পরিস্কার করেই বলেছেন। উনারা দাবী করেছেন সামান্য ভূ-খন্ডের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করছেন না। শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম সম্পর্কে খোঁজ খবর করলে জানতে পারবেন তার জিহাদী কার্যক্রম ও অনুসারীদের সংখ্যা কত। আফগানিস্থান, সৌদি আরবসহ আরব বিশ্বের মসজিদগুলোতে শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম ঘন্টার পর ঘন্টা পশ্চিমাদের উপর হামলা করার উপর বয়ান করেন। নিজেই সেটা তার লেখায় বলেছেন। তরুণদের তিনি হুর-জান্নাত লাভের জন্য ইহুদীদের হাত থেকে বাইতুল মোক্কাদেশ দখলের আহ্ববান জানান। তাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, আল্লাহ সব মুসলমানের জীবন জান্নাতের বিনিময়ে জিহাদের জন্য ক্রয় করে নিয়েছেন…। 

মজাটা হচ্ছে ফিলিস্তিনী বামপন্থীরা যখন ইজরায়েলের বিরুদ্ধে সেখানকার সংগ্রামকে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার আন্দোলন বলেছে তখন শাইখ আব্দুল্লাহ আযম তাদের বিদ্রুপ করে বলেছেন, “ফিলিস্তিনী যুবকদের আন্দোলিত করছে ইসলাম, মসজিদুল আকসা ও শাহাদাতস্পৃহা…”। 

তাহলে স্বাধীন ফিলিস্তিনী রাষ্ট্র যে কি চেহারা পাবে তা কি বলে দিতে হবে? সেই ফিলিস্তিনে কি মিয়া খলিফার মত কেউ স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারবে? এডওয়ার্ড সাঈদ বাম বুদ্ধিজীবী ইজরায়েল আগ্রাসনে শরণার্থী হয়েছিলেন, আমেরিকাতেই বাকী জীবন কাটিয়েছিলেন। তিনি ফিলিস্তিনী খ্রিস্টান ছিলেন। ইসলামের সমালোচনাকে তিনি ‘ইসলাম বিদ্বেষ’ মনে করতেন। তো আবদুল্লাহ আযমিদের হাতে স্বাধীন হওয়া ফিলিস্তিনে কি সাঈদের মত খ্রিস্টান পরিবারগুলো সমান নাগরিক মর্যাদা পাবে? এমন কোন ‘মুসলিম রাষ্ট্রে’ তার নজির আছে? এখন তো আর ইয়াসির আরাফাত বেঁচে নেই, তার আন্দোলনও ছিনতাই হয়ে গেছে। ফিলিস্তিনী শিশুরা এখন ‘কাফের’ মারতে তৈরি হয়। বালকরা হুর আর জান্নাতের লোভে ইহুদিদের কাছ থেকে বাইতুল মোকাদ্দেস দখল করতে চায়...।

কুরআনের সুরা আসসাফ তুলে ধরে ফিলিস্তিনীদের বলা হয় মুসলমানদের জন্য আল্লাহ একটা “লাভজনক ব্যবসা” দিয়েছে জিহাদের প্রাণ দেয়ার বিনিময়ে হুর ও জান্নাত পাবার। আর জিতে ফিরে আসলে গণিমতের মাল। সুরা আসসাফ বলছে- 

“يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَىٰ تِجَارَةٍ تُنجِيكُم مِّنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ [٦١:١٠]
تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنفُسِكُمْ ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ [٦١:١١]
يَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَيُدْخِلْكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ ۚ ذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ [٦١:١٢]
وَأُخْرَىٰ تُحِبُّونَهَا ۖ نَصْرٌ مِّنَ اللَّهِ وَفَتْحٌ قَرِيبٌ ۗ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ [٦١:١٣]

“হে মুমিনগণ ! আমি কি তোমাদেরকে এমন এক ব্যবসার সন্ধান দিব, যা তোমাদেরকে যন্ত্রণদায়ক শাস্তি থেকে মুক্তি দিবে। (আর তা হচ্ছে এই যে) তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ঈমান আনবে এবং আল্লাহ্র পথে তোমাদের  জান ও মাল দ্বারা জ্বিহাদ করবে। তোমাদের এ কাজই তোমাদের জন্য সর্বোত্তম যদি তোমরা জান। তিনি তোমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দিবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতে, যার তলদেশে দিয়ে প্রবাহিত হয় নদীসমূহ ও (তোমাদেরকে প্রবেশ করাবেন) স্থায়ী জান্নাত সমূহের উন্নত আবাসস্থলে। আর এটাই হচ্ছে মহা সফলতা। আর তোমরা তো আখেরাতকে ভালবাস।আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য সমাগত ও বিজয় নিকটবর্তী। আর আপনি মুমিনদেরকে সুসংবাদ দিন।[আসসাফঃ ১০-১৩]”।

জিহাদীরা (আমাদের দেশের একশ্রেণী বুদ্ধিজীবীর কাছে যারা ফিডম ফাইটার!) এই সুরাকে দেখিয়ে বলছে, ‘আমি কি তোমাদের একটি ব্যবসার সন্ধান দিব?’ এটা সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবসা। আল্লাহ ও বান্দার মাঝে সম্পাদিত ব্যবসা । ক্রেতা মহান আল্লাহ আর বিক্রেতা আপনি। অতএব আপনি অনেক উপরে উঠে গেলেন। আপনি রাব্বুল আলামীনের সাথে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদন করছেন। এর চেয়ে বড় সম্মানের বিষয় আর কী হতে পারে?’।
আমরা কেমন করে এইসব আন্দোলনকারীকে সমর্থন করব? ফিলিস্তিনি প্রসঙ্গে, আফগান প্রসঙ্গে পশ্চিমাদের নীতি সমালোচনা বা বিরোধীতা কেন অন্ধভাবে এইসব রক্তলোলুপ শায়খ আবদুল্লাহ আযমদের পরক্ষ সমর্থন করবে? আজো আমরা আফগানিস্থানের একেফরটিসেভেন হাতে কাবলি পরা যোদ্ধাদের, ফিলিস্তিনী মুখ ঢাকা প্রেট্রল বোমারুদের, কাশ্মীরে পাথর ছোড়া যুবকদের সমর্থন করছি ঠিক কিসের লক্ষ্যে? ফিলিস্তিনিদের জীবনের লক্ষ্য কি? কি চায় তারা? পকেটে পাথর নিয়ে আল আকসায় নামাজ পড়তে যেয়ে ইজরায়েল সৈন্যদের মাথা ফাটিয়ে একটা গন্ডগোল পাঁকানো। সেই গন্ডগোল থেকে হামাস রকেট ছুড়বে। তাতে ইজরায়েলের একটি পক্ক কেশও উপড়ে ফেলা যাবে না। কিন্তু ইজরায়েল পাল্টা হামলা চালালে বিশ্ব তোলপাড় হয়ে যাবে। এটা কেউ চাইছে। সেই চাওয়ার বলি হচ্ছে ফিলিস্তিনীরা। ফিলিস্তিনিরা কেউ স্কুলে যায় না। কেউ অধ্যাপক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে স্বপ্ন দেখে না। কেউ মহাকাশ নিয়ে ভাবে না। কেউ নোয়ান হারিরি বই পড়ে না। তাদের একটাই জীবন- ইজরায়েল সৈনিকদের আড়াল থেকে পাথর ছুড়ে মারা, বেলুনে আগুন লাগিয়ে ইজরায়েলের ফসলের খেত পুড়িয়ে দেয়া, তারপর ইজরায়েল সৈন্যরা এসে ধরে নিয়ে যাবে এক হাত ধরে আর অন্য হাতে ধরে রাখবে তার পরিবারের বাকী সদস্যরা। এই ছবি ছাপা হবে কাগজে। দিকে দিকে ইজরায়েল বর্বরতা ছড়িয়ে পড়বে। হামাসের ফান্ডে কোটি কোটি তেলবেচা ডলার এসে যাবে।... এতে ফিলিস্তিনিদের কি লাভ হবে? কাশ্মীরে পাথর ছুড়ে কি লাভ হয়েছিলো কাশ্মীরীদের? লেখাপড়া ব্যবসা কোন কিছু না করে তাদের পিছিয়ে পড়ায় কাদের লাভ হয়েছিলো? কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা উচ্ছেদের পর কাশ্মীরের পর্যটনে সেই পাথর ছোড়া যুবকরাই কাজ করছে। ফিলিস্তিনিদের ইজরায়েলের সঙ্গে ব্যবসা চাকরির সম্পর্ক করতে হবে। পাথর ছোড়া বাদ দিয়ে মন দিয়ে লেখাপড়া করতে হবে। সারারাত জেগে পেট্রলবোমা নিয়ে আল আকসায় নামাজ পড়ার নামে আগুন লাগিয়ে দেয়ার চিন্তা থাকলে সেখানে মহাকাশ নিয়ে ভাবনা আসবে কোত্থেকে? কেউ হয়ত বলবেন, স্বদেশ যখন পরাধীন তখন ফিলিস্তিনিদের এইসব চিন্তা করতে বলছি কেন? বলছি এ কারণে, ফিলিস্তিনিদের আগে ইজরায়েল রাষ্ট্রকেই মেনে নিতে হবে। তারপর তাদের রাষ্ট্রচিন্তা। ইজরায়েল যেভাবেই গঠিত হোক, এটা বাস্তবতা। তাকে মেনে নিয়েই ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা। কিন্তু তারচেয়ে বড় কথা, ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব এখন জঙ্গিদের হাতে। শুভবুদ্ধির উদয় তো বহুদূরের পথ...।

©সুষুপ্ত পাঠক

0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted