কোরআনে সংস্কৃত শব্দের উপস্থিতি: একটি পর্যালোচনা'

'কোরআনে সংস্কৃত শব্দের উপস্থিতি: একটি পর্যালোচনা'

কোরআনের অনেক শব্দের আদি উৎস ঘেঁটে দেখানো সম্ভব বহু শব্দের উৎস ধাতু সংস্কৃত থেকে এসেছে। কথ্য আরবির অনেক শব্দই মধ্য ফার্সি বা মিডল পার্সিয়ান থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে। 

মধ্য ফার্সি ভাষাকে বলা হয়ে থাকে পাহলাবী। এই পাহলাবী ভাষাটা ট্র্যাক ব্যাক করলে মোটামুটি খৃষ্টপূর্ব আড়াইশ থেকে তিনশ সাল পর্যন্ত যাওয়া যায়। তো এই পাহলাবী ভাষাকে সাসানীয় সাম্রাজ্যের (খৃষ্টীয় ২২৪ - ৬৫১) আমলে পারস্যের সরকারী ভাষা ঘোষণা করা হয়। খেয়াল রাখতে হবে এই সময়ের পরেই খলিফা উমরের রাজত্বকালে পারস্য ইসলামী হুকুমতের আন্ডারে চলে আসে। 

মোটকথা হচ্ছে রসূলের জন্মের আড়াইশ বছর আগে থেকেই পাহলাবী ভাষাটা পারস্যের সরকারী ভাষা এবং রসূলের জন্মের আটশ বছর আগে এই ভাষার গ্রামারের উদ্ভব হয়। এর আগের প্রমিনেন্সি পাওয়া আদি ফার্সি ভাষার গ্রামার ছিল বেশ কঠিন। 

আরবে যেহেতু রিটেন টেক্সট কম ছিল আর বিপরীতে ফার্সি রিটেন গ্রামার ছিল স্টাব্লিসড, ফলে আরবি ভাষাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে ফার্সি ভাষা। 

আবার এদিকে এই পারস্যের সেই সময়ের মূল ধর্ম জোরাস্ট্রানিজমের  কেন্দ্রীয় গ্রন্থ আবেস্তার সবচেয়ে পুরাতন মেনুস্ক্রিপ্টটা উদ্ধার করে এর ভাষাকে রি-কনস্ট্রাক্ট করা হয় সাসানীয় সাম্রাজ্যের আমলেই। এই পুনরুদ্ধারের সময় যেই ভাষাটার সাথে আবেস্তার গিরায় গিরায় মিল খুঁজে পাওয়া যায় সেটা হচ্ছে সংস্কৃত!

এখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসবে রি-কনস্ট্রাক্ট করা হইলে এর আদি গ্রন্থ কখন নাজেল হইছিলো? 

এই প্রশ্ন কঠিন। মোটামুটি মনে করা হয় নবী জরাথ্রুস্টের আগমন হইছিল ঈসা নবীর জন্মের ৬০০ থেকে ৮০০ বছর আগে। তবে তা হইলেও এই বইটার রুট অন্তত দুই হাজার বছর পুরাতন। মানে এটা একটা ডেভলাপিং গ্রন্থ যেটা ধাপে ধাপে নাজিল হয়েছে। শাহনামা পড়লে বুঝতে পারবেন।

আজকের দিনের যেই ইরান, এই ইরান শব্দটা আবেস্তায় উল্লেখিত Airyana Vaeja শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ হল আর্য জাতির আদি বাসভূমি। আর্য শব্দটা শুনেই হিটলারি বিশুদ্ধ রক্তের কথা মাথার মধ্যে নিয়ে চলে আইসেন না। আরিয়ান বলতে মূলত ইন্দো-ইরানীয়ান পিপল বোঝানো হয়। জাস্ট এটুকুই। 

একটু ম্যাপ খুলে যদি রাজস্থানের একেবারে শেষ লোকালয়টা থেকে ইরানের কুহাক শহর পর্যন্ত একটা রেখা টানেন তাহলে দূরত্ব হবে মাত্র সাড়ে আটশ কিলোমিটার। পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা থেকে কক্সবাজার সি-বিচের দূরত্বও সাড়ে আটশ কিলোমিটার! 

এবারে পার্টিশনের আগে পাকিস্তান ছিলো হিন্দুস্তান এবং পাকিস্তানের সাথে ইরানের বর্ডার ৬০০ কিলোমিটারের। ফলে আরিয়ান বলতে যেই 'ইন্ডীয়ান আর ইরানীয়ান কালচারের মিক্সড' বিষয়টা বোঝানো হয় এখানে আর কোন সুপিরিয়র পলিটিক্স খোঁজ কইরেন না। জোসেফ উইজেহোফার, উইল ডুরান্ট এবং জাক্কো হাক্কিনেনের মত স্কলাররা কিন্তু এই ইথিনো টার্মলোজিতে আপত্তি করেন না। 

এখন দেখেন খৃষ্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগে বেদও লেখা হচ্ছে আবার আবেস্তাও টুকটাক লিখিত হচ্ছে। সাসানীয় আমলে উদ্ধার হওয়া টেক্সট পড়ে দেখা গেলো টেক্সটের গল্পগুলোও খুবই কাছাকাছি (বিস্তারিত আলাপের জন্য এই লেখকের 'এটা আমার দর্শনের নোটখাতা নয়' গ্রন্থ দ্রষ্টব্য)। 

ধরেন আমাদের অতি পরিচিত শব্দ নামাজ দিয়ে শুরু করা যাক। আমরা অনেকেই জানি না আমাদের 'সালাত' বলতে বহুল প্রচলিত ফার্সি 'নামাজ'  শব্দটি সংস্কৃত থেকে প্রভাবিত। 

নামাজ কেবল মুসলমানদের প্রেয়ার নয়, জোরাস্ট্রানরাও নিজেদের পাঁচ ওয়াক্তের প্রার্থনাকে নামাজ বলে। নামাজ বলতে জোরাস্টাররা বোঝে মেডিটেশন বা Mental Focus। 

তাদের আবেস্তায় কাব্যিকভাবে শব্দটা এসেছে নানা প্রকারে। যেমন: Nem.añg.hö, Nema, Nemas, Nemö ইত্যাদি। প্রাচীন ইন্দো-ভারতীয় বৈদিক লিটারেচারেও এই Nemö প্রত্যয়  উদ্ভূত একাধিক শব্দের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যেমন: नमस् (Namas), नम (Nama), नमो (Namo)।

অর্থাৎ নামাজ এবং নমোঃ এই দুই শব্দের উৎস একই, সেটা সংস্কৃত Nemö। একইভাবে:

- সংস্কৃত বলছে Madhu (মাধু), আবেস্তা বলছে Madu, অর্থও মধু,
- সংস্কৃত বলে Mantra (মান্ত্রা), আবেস্তায় লেখা Manthra, যার অর্থ sacred spell,
- সংস্কৃত বলছে Amarattya (আমারাত্যা), আবেস্তান ভাষায় Ameretat, যার অর্থ immortality,
- সংস্কৃত বলছে Ashman (আসমান), আবেস্তা বলছে Asman, অর্থ আসমান, sky,
- সংস্কৃত বলছে Amrita (অমৃতা), আবেস্তা বলে Amesha, অর্থ nectar of immortality,
- সংস্কৃত বলছে Vayu (ভায়ু), আবেস্তান ভাষায় Vaiiu, অর্থ wind (বাতাস),
- সংস্কৃত বলছে Bhuta (ভূতা), আবেস্তা বলছে Buiti, অর্থ ghost (ভূত),

একই ভাবে সংস্কৃত বলছে Asura, আবেস্তা বলছে Ahura। সংস্কৃত বলছে Manu, আবেস্তাও বলছে Manu, দুটোই Man। সংস্কৃত বলছে Mitra, আবেস্তা বলছে Mithra। সংস্কৃত বলছে Sarasvatī, আবেস্তা বলছে Haraxvaitī, যে কিনা A river goddess। সংস্কৃত বলছে Yajña, আবেস্তা বলছে Yasna, মানে দাঁড়াচ্ছে Worship, Sacrifice, Oblation। সংস্কৃত বলছে Ushas, আবেস্তা বলছে Ushah, অর্থ Dawn। সংস্কৃত বলছে Ahuti, আবেস্তায় লেখা Azuiti অর্থ হচ্ছে Offering। 

তো বুঝতেই পারছেন সংস্কৃত কিভাবে ইনফ্লুয়েন্স করেছে আবেস্তাকে এবং ফার্সি ভাষাকে। 

এবারে ফার্সি থেকেই যেহেতু আরবি ভাষার ব্যাকরণ কিছুটা প্রভাবিত তাই ফার্সি থেকে আরবির ডেভলপমেন্টের বহু উদাহরণ তো পাবেনই- সাথে সাথে সংস্কৃত থেকে আরবির ডেভলপমেন্টের এমন কিছু উদাহরণ দেখবেন এমনকি একেবারে কোরআনে ইউজ হওয়া শব্দের এমন সংস্কৃত উৎস দেখবেন যে আপনার মগজ চক্কর দেয়া শুরু করবে। 

যখন বুঝতে পারবেন আপনার বিশ্বাসের আসমানি কিতাবে খোদা সংস্কৃত ধ্বনি ব্যবহার করেছেন তখন কি আপনাদের সংস্কৃত ল্যাঙ্গুয়েজের প্রতি বিদ্বেষ কমবে? 

যেমন ধরেন কোরআন বলছে:

'লাকুমদ্বীনূকুম ওয়ালীয়া দ্বীন' (কাফিরুন: ৬)

বন্ধু আপনি কি জানেন এই আয়াত সহ কোরআনে যতবার 'দ্বীন' শব্দটা এসেছে সেই 'দ্বীন' পাহলাবী 'দেন' শব্দটা থেকে উদ্ভূত।

এই 'দেন'  এসেছে প্রাচীন ফার্সি 'দায়েনা' থেকে, সংস্কৃতে এই শব্দটাই Dhyain, যেটার মূল শব্দ Dhyai (ধাইআই) যার অর্থ বোঝা বা চিন্তা করা, এখান থেকেই এসেছে আমাদের বহুল প্রচলিত 'ধ্যান' শব্দটি, মূল ধাতুর অর্থ To meditate, to recollect, To think closely। কি বুঝলেন? 

এরপর সূরা ইনসানের ১৩ নাম্বার আয়াতে 'অত্যন্ত ঠাণ্ডা' বোঝাতে এসেছে জামহারীর (Zamhareer) শব্দটা।

'জামহারীর' শব্দের প্রথম অংশ 'জাম' এসেছে পাহলাবী 'যিম' থেকে, এর অর্থ 'ঠাণ্ডা'। আবেস্তাও ঠাণ্ডা বলতে এই শব্দটা এসেছে। সংস্কৃতে এইটাই 'হিম'। 

জি ভাই যেই হিম শীতল ঠাণ্ডা হাওয়ার কথা আপনি আমি বলি সেই হিম শব্দটা চার হাজার বছর আগে আমাদের ভাষা থেকে গেছে ফার্সিতে সেখান থেকে দেড় হাজার বছর আগে আসছে কোরআনে। 

একই সূরার পাঁচ নাম্বার আয়াতে পাবেন Kaafooraa শব্দটা, এইটার রুটও সংস্কৃত Karpūra (कर्पूर) মানে বাংলা ভাষার কর্পূ। একেবারে ভাই কসম খোদার। গ্রামার খোঁজ করে দেখেন। অনেকে ভাবতে পারেন এই শব্দ ফার্সি হয়ে বাংলায় ঢুকেছে, বিষয়টা এমন যে না সেটার জন্য আপনি সরাসরি গুগলের সাহায্য নিয়ে দেখতে পারেন। 

আবার দেখেন আরবিতে চিনি বা মিষ্টি বলতে যেই sakar (سكر) বলা হয় সেটাকে প্রভাবিত করেছে সংস্কৃত śarkarā, খুব পরিচিত লেবুকে আরবিতে বলে (ليمون) lymun শব্দের সরাসরি যোগাযোগ আছে সংস্কৃত nimbū'র সাথে।  

এরপর কোরআনে সুগন্ধি মিশকের কথা বলা হয়েছে অনেকবার, এখান থেকে মিশওয়াক এসেছে, এই মিশকের আদি উৎস হচ্ছে সংস্কৃত (Musk) মুশক থেকে। 

মুশক হচ্ছে সেই সুগন্ধি যেটা একটা বিশেষ প্রজাতির হরিণের নাভী গ্রন্থি থেকে পাওয়া যায়। এই হরিণের নাম কস্তুরী মৃগ। 

আর এই কস্তুরীটা মূলত পুরুষ হরিণের পেটে অবস্থিত সুগন্ধী গ্রন্থি নিঃসৃত সুগন্ধীর নাম। মিলন ঋতুতে পুরুষ হরিণের পেটের কাছের কস্তুরী গ্রন্থি থেকে সুগন্ধ বের হয়, যা মেয়ে হরিণকে আকৃষ্ট করে ৷ ঋতুর শেষে তা হরিণের দেহ থেকে খসে পড়ে যায়৷ সেটা সংগ্রহ করে রোদ শুকিয়ে কস্তুরী তৈরি করা হয়। 

গৌরি প্রসন্ন মজুমদারের লেখা হেমন্ত মুখপাধ্যায়ের গাওয়া 'আমি দূর হতে তোমাকেই দেখেছি'- এই গান কে শোনানি? কি দরদ দিয়ে উনি গেয়েছেন-

"কস্তুরি মৃগ তুমি- 
যেন কস্তুরি মৃগ তুমি
আপণ গন্ধ ঢেলে এ হৃদয় ছুঁয়ে গেলে
সে মায়ায় আপনারে ঢেকেছি"

আপনি কি জীবনে কখনো এই গান শোনার সময় ভেবেছিলেন কোরআনে এই শব্দটা এসেছে ঠিক এই গানের ভাষাটা থেকেই?

মুশক শব্দটা কিভাবে অলংকারিক নাম কস্তূরী পেয়ে গেলো সেটা বেদান্তের আরেক গল্প। সেই গল্প সামনে কোনদিন হবে। 

সামনের দিনগুলোতে আমরা এ-ও দেখবো কিভাবে হিন্দুইজম আর ইসলাম জোরাস্ট্রানিজমকে মাঝে রেখে একই গল্প বিনিময় করে গেছে চার হাজার বছর ধরে। আমরা দেখবো কিভাবে আজকের অক্ষরবাদীদের বহু অনুষঙ্গ ভারতবর্ষ থেকে ইরান হয়ে মক্কায় পৌঁছেছে। কিভাবে প্রেমের সাথে আমাদের রসূল সংস্কৃতের ভান্ডার থেকে অকাতরে নিয়ে আলো বিলিয়েছেন এবং কিভাবে সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলেও দুটো দর্শনই মূলত একই কথা বলে গেছে।

কালচারের এই উৎসকে বুঝতে পারলে আমাদের সহবস্থানের বোঝাপড়া যেমন ভালো হবে তেমনি পরস্পরকে আমরা আসলে আরও বেশি রেস্পেক্ট করতে পারবো। 

-

আপনারা একটা বিষয় খেয়াল কইরেন, সংস্কৃতও কোন নাজেল হওয়া ভাষা না। ফলে সংস্কৃতেও থেমে যাবার কোন সুযোগ নেই। 

ভাষা একটা চলমান বিষয়। এটার না আছে শেষ না আছে শুরু। এরকম বহু সংস্কৃত ধাতু দেখানো যাবে যেটা এসেছে চীনের নানা টুকরো টুকরো ধ্বনি থেকে। 

আমি মূলত আপনাদের দেখাতে চেয়েছি এক ভাষার শব্দ আমরা অন্য ভাষা থেকেও পেয়ে যেতে পারি। আমি কখনোই দাবী করছি না আরবী সর্বতভাবে সংস্কৃত প্রভাবিত। ফার্সির ক্ষেত্রেও তাই। 

এই ভাষার দেয়া নেয়াটা হাজার বছর ধরেই চলমান। ইন্দো ইরানিয়ান ট্রি-তে তিনশ ভাষা আছে, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের উপর প্রভাব রাখসে। এখানে কোন একটা ভাষা থেকে সব ভাষা আসছে এটা বলার কোন সুযোগ নাই। বহু  ফার্সি ধাতু সংস্কৃত শব্দে পাবেন। যেই ফার্সি হয়তো আরব থেকে তার ধ্বনি নিয়েছে। ভাষার বিষয়টাই এরকম। 
 
এই আলোচনায় ব্যাবহার করা শব্দ গুলো আমি নিয়েছি ডক্টর শেখ গোলাম মাকসুদ হেলালির 'ইরান ও ইসলাম এবং তাদের পারস্পরিক প্রভাব' বইটা থেকে। সেখানে এরকম অনেক শব্দ আছে যেটা ফার্সি ও আরবি থেকে সংস্কৃতে ঢুকেছে। সেই গল্প আগামী দিনের জন্য।

-


0/Post a Comment/Comments

যুক্তি সংগত কথা বলুন.................

Stay Conneted